৮ জুলাই ২০২৪, সোমবার

বাংলা ব্লকডে স্থবির রাজধানীসহ সারাদেশ

শিক্ষার্থীরা টানা ষষ্ঠ দিনের মতো কোটা বিরোধী অবস্থান নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে তাদের ‘বাংলা ব্লকড’র কারণে কয়েক ঘন্টার জন্য পুরো রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ে। মূলত গতকাল রোববার বিকেল ৩টা থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সড়ক অবরোধ শুরু করেন। সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে 'বাংলা ব্লকড' কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হন এবং বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ঢাবি শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রথমে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কাছে চাঁনখারপুল মোড়ে অবরোধ করেন এবং ফ্লাইওভারের র‌্যাম্প অবরোধ করেন। এ সময় ইডেন মহিলা কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্সল্যাব মোড় ও নীলক্ষেত মোড় বন্ধ করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলসহ আশপাশের কলেজ নিয়ে চানখারপুল মোড় অবরোধ করেন। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগারগাঁও সড়কে অবস্থান নেন। এতে মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ি, হানিফ ফ্লাইওভারসহ সংযুক্ত সব সড়ক অচল হয়ে যায়। একইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর মোড় বন্ধ করে দেয়। ফলে সায়েন্সল্যাব থেকে মৎস্য ভবন, শাহবাগ থেকে বাংলামোটর, মিন্টু রোডসহ সংযুক্ত একাধিক সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক, ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কসহ বিভিন্ন জেলায় গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন বলে জানান শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদ আলী। এর ফলে ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। কর্মসূচি অনুযায়ী, ঢাবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর চানখারপুল, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, আগারগাঁও, মহাখালী ও পল্টন এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে।

বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিলেও বড় অংশই মূলত জড়ো হন শাহবাগ মোড়ে। তারা রাস্তায় বসে সমস্বরে ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার', ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘কোটা প্রথা, বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’-ইত্যাদি স্লোগানে উত্তাল করে রেখেছেন শাহবাগ এলাকা। গান-কবিতা, গল্পেও চলে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ।

আন্দোলনে অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থী নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের যদি বাধ্য করা হয় আমরা প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনে যাব। পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা আজ শাহবাগে জড়ো হয়েছি। পরবর্তী কর্মসূচি যা দেওয়া হবে, আমরা সে অনুযায়ী তা পালন করব। এর আগে শনিবার (৬ জুলাই) কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দিয়েছিলেন, রোববার বিকেল ৩টায় সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ‘বাংলা ব্লকড’ কর্মসূচি শুরু হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা অবরোধ কর্মসূচি শেষ করেন। শিক্ষার্থীরা সড়ক ছাড়ার পর সায়েন্সল্যাবের সড়কে আবারও যানচলাচল শুরু হয়। সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা সায়েন্সল্যাব মোড় ছেড়ে চলে যান। এ সময় তারা একটি মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত মোড়ের দিকে চলে যান।

আন্দোলন সমাপ্তি ঘোষণার আগে শিক্ষার্থীরা জানান, কোটা প্রথা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আজ থেকে আবারও তাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলবে। এর আগে দুপুর ২টার দিকে নীলক্ষেত থেকে মিছিল নিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবস্থান নেন তারা। এর ফলে মুহূর্তেই গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড় বন্ধ করে রাখায় শাহবাগের আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেয়। এমনকি মোড় বন্ধ করে দেওয়ার আগে যেসব গাড়ি শাহবাগের আশপাশে অবস্থান করছিল সেগুলোও আটকা পড়ে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কোটা বাতিল ঘোষণা করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ছাত্র সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ শ্রেণিকে যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা বাতিল করতে হবে। অন্যথায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।

দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় সড়ক অবরোধ করে ঢাকা কলেজ ও আশপাশের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ব্যস্ত মোড় অবরোধ করে আশেপাশের এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেন। ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম বলেন, 'আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেছেন। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। অবরোধে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নগরবাসীকে ওই এলাকা এড়িয়ে চলতে বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ডেইরিগেট এলাকায় অবরোধ তৈরি করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শতাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সাঈদ জানান, দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত মহাসড়ক ছেড়ে চলে যান। সকাল ১১টার দিকে জাবি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ডেইরিগেট এলাকায় অবস্থান নেয়। অবরোধের ফলে মহাসড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকে থাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।

অবরোধের কারণে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, কমলাপুর, ডেমরা স্টাফ-কোয়ার্টার, সিলেট, চিটাগাং রোড, নারায়ণগঞ্জ, পোস্তগোলা, পাগলা, শনির আখড়া, সাইনবোর্ডে যাওয়ার এবং আসার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফ্লাইওভারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে শত শত গাড়িকে।

বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন এবং নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেন। তারা কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে স্লোগান দেন। তাদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর মহাসড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজট শুরু হয়। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিচুল হক বলেন, ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান করেন। তখন স্থানীয় ও দূরপাল্লার বাসগুলো নথুল্লাবাদ ছেড়ে যেতে পারছিল না বলে জানান ওসি।

দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়ক এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। সকাল ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করেন এবং কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। তারা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের সামনের মহাসড়কে যান এবং সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এর ফলে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে।

দিনাজপুর সদর থানার (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ফরিদ হোসেন জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসড়কে অবস্থান করেছেন। পরবর্তীতে তারা মহাসড়ক থেকে সড়ে গেলে দিনাজপুর-ঢাকা ও দিনাজপুর-পঞ্চগড় রুটে যান চলাচল ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২০২১ সালে সেই পরিপত্রের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে’র অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওইদিন এই আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন চেম্বার আদালত।
সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছিলেন, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে নাকি বাতিল হবে সে ব্যাপারে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
পরে গত ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রাখার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে গত এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা।

https://www.dailysangram.info/post/560626