দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আরও তিন দিন অবনতির দিকে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এ সময়ে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি বেড়ে যাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে এ অঞ্চলের ছয় জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বন্যার মধ্যমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং অন্যান্য নদীর পানি কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা, নুনখাওয়া, হাতিয়া, চিলমারী, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, সাঘাটা, সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে করে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের সংশ্লিষ্ট নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ শেষে নদীর পানির সমতল স্থিতিশীল হয়ে আসতে পারে। দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির সমতল সার্বিকভাবে কমা শুরু করতে পারে এবং ওই সপ্তাহের শেষের দিকে চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
এদিকে পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি আগামী তিন দিন বেড়ে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। এর ফলে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরের নদীসংলগ্ন কিছু নি¤œাঞ্চল স্বল্পমেয়াদে প্লাবিত হতে পারে। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে নদীর পানির সমতল কমতে পারে এবং পরবর্তীতে চলমান পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে বলে আশা করছেন প্রকৌশল উদয় রায়হান।
পরবর্তী দুই দিনে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনাশ্বরী, করতোয়া, বাঙালি, আপার, করতোয়া, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, ইছামতি-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট যমুনা নদীর পানি সময়বিশেষে দ্রুত বেড়ে যেতে পারে।
এবার জুনের শুরুতে প্রবল বর্ষণ আর উজানের ঢলে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। কয়েক দিন পর পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গত ১৭ জুন কোরবানির ঈদের আগের দুই দিন থেকে টানা বৃষ্টিতে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণাসহ আশেপাশের জেলার অনেক এলাকা ডুবে যায়। উজানের ঢলে জুলাইয়ের শুরুতে নতুন করে বন্যা দেখা দেয় ওই তিন জেলায়।
গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী: ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গাইবান্ধার চারটি উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ২৯ হাজার পরিবার। নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় নদীতীরবর্তী ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে জেলায় ১৮১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নে সরেজমিন দেখা গেছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগের চিত্র। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে চরাঞ্চলে নির্মিত ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। অনেক টিনশেড ঘর বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে নৌকায় করে ঘরের চাল নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ আসবাব ও ধান-চাল উঁচু জায়গায় আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে আসছেন।গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গাইবান্ধার চারটি উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ৫টি, সুন্দরগঞ্জে ৭টি, সাঘাটায় ৮টি ও ফুলছড়িতে ৭টি। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে মোট ২৮ হাজার ৯২৮টি পরিবার। এর মধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ৩ হাজার ৫১৮টি, সুন্দরগঞ্জে ৪ হাজার ৭০০টি, সাঘাটায় ১৩ হাজার ২৯০টি ও ফুলছড়িতে ৭ হাজার ৪২০টি। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় ১৮১টি স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ২৪টি, সুন্দরগঞ্জে ৪৮টি, সাঘাটায় ৩৬ এবং ফুলছড়িতে ২৩টি, সাদুল্ল্যাপুরে ৩৩টি, পলাশবাড়ীতে ৬টি ও গোবিন্দগঞ্জে ১১টি।কামারজানি ইউনিয়নের খারজানি গ্রামের আবদুল খালেক (৪৫) বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে নদীর পানি খুব বাড়ছে। রাতে আমাদের বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। রান্না করতে পারছি না। খুবই কষ্টে আছি।’ কুন্দেরপাড়া গ্রামের কৃষক চান মিয়া (৬০) বলেন, ‘কষ্ট করে খাবারের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু প্রাকৃতিক কাজ সারতে সমস্যায় পড়েছি। বিশেষ করে নারীরা দুর্ভোগে পড়েছেন বেশি।’ এসব বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) জুয়েল মিয়া বলেন, বন্যাকবলিত চারটি উপজেলায় এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ৩ হাজার ৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার, ১৬৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। এসব বিতরণ শুরু হয়েছে। পানিবন্দীদের উদ্ধারের জন্য নৌকা, স্পিডবোট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। জেলা ও উপজেলায় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। ইউনিয়নভিত্তিক বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় মেডিকেল টিম, কৃষি টিম, স্বেচ্ছাসেবক টিম ও লাইভস্টোক টিম গঠন করা হয়েছে।জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম জানান, জেলার চারটি উপজেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গতকাল থেকে পানিতে নিমজ্জিত। এ কারণে ৭০টি বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। ১৫টি বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিদ্যালয়ে আগের মতো পাঠদান কার্যক্রম চালু করা হবে। নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধার চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের খারজানি গ্রাম থেকে তোলা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধার চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ১৯ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকালের তুলনায় পানি কম বেড়েছে। একই সময়ে তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলা-সংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ২১ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। দুপুর ১২টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। একই সময়ে করতোয়ার পানি ১৪০ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অপর দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, নদ-নদীর পানি বাড়লেও আপাতত বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। উজানের ঢলে ও ভারী বৃষ্টির কারণে নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার অন্যতম দুই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে এবং দুটির পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম থেকে মোস্তাফিজুর রহমান : কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে এবং জনদুর্ভোগ বেড়েছে। চলতি সপ্তাহের শনিবার থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে এবং উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় পানির তোরে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার নুনখাওয়া ও তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। যা নদনদী এলাকায় নি¤œাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং জেলার প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ রাস্তা ও লোকালয় পানিতে টইটম্বুর হয়েছে। এতে অন্তত লক্ষাধিক পরিবার পরিজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ফলে প্রায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষের দুর্ভোগ চরমভাবে বেড়েই চলেছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে- যেসকল নদনদীর পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে- কুড়িগ্রামের হাতিয়া ব্রহ্মপুত্র পয়েন্টে ৮০ উপরে, কুড়িগ্রামের চিলমারী ব্রহ্মপুত্র পয়েন্টে ৭৮ উপরে, কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া ব্রহ্মপুত্র পয়েন্টে ৭২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে চলছে প্রবল স্রোতে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
জামালপুরে যমুনার পানি বিপদসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার উপরে
জামালপুর সংবাদদাতা: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ের ঢলে জামালপুরে যমুনা,ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকাল ১২ টার দিকে দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ গার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘন্টায় ৩৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ৯৩ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর মাদারগঞ্জ উপজেলার মোট ১৮টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল পাট, ইক্ষ,কাঁচা,তরকারি, শাকসবজিসহ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার দেওয়ানগঞ্জ- খোলাবাডি সড়কের একটি সেতুর সংযোগ সড়ক ও কাঁঠার বিল এলাকার দেওয়ানগঞ্জ সানন্দবাড়ী আঞ্চলিক সড়কের ৩০ মিটার সড়ক ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়েছ। এছাড়া ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল ইসলামপুর-উলিয়া ইসলামপুর-মাহমুদপুর রোড মাহমুদপুর-মেলান্দহ রোড বন্যার পানিতে তলিয়ে জেলা উপজেলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্রায় ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বন্যা কবলিত পরিবার ও গবাদি পশু আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পূর্ণ ভার্সন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, বন্যার্তদের জন্য ৩শ’ মেট্রিক টন চাল ও ৩হাজার ৪শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ হয়েছে। ১১ টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।