১৪ জুন ২০২৪, শুক্রবার, ১০:২৪

কোরবানির পশু চাহিদার চেয়ে বেশি, তবু কমছে না দাম

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে এবার চাহিদার চেয়ে কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি। তবু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার হাটে পশুর দাম বেশ চড়া। ইতিমধ্যে হাটে পশু কিনতে গেছেন এমন ক্রেতাদের ধারণা, গত বছরের চেয়ে পশুর দাম এবার অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি।
যদিও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলছেন, কৌশলে কিংবা ছলচাতুরী করে যাঁরা কোরবানির পশুর দাম বাড়াচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের ‘মাথায় হাত’ পড়বে।

মন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এবার কোরবানির পশুর চাহিদা ১ কোটি ৭ লাখ। সেখানে গরু-ছাগলসহ কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত আছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। ২২ লাখের বেশি পশু বাড়তি আছে। বাজারে যেকোনো পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। দেশে প্রয়োজনের চেয়ে পশুর উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি আছে।

কৌশলে কিংবা ছলচাতুরী করে যাঁরা কোরবানির পশুর দাম বাড়াচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের ‘মাথায় হাত’ পড়বে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান
প্রাণিসম্পদ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি রেকর্ডসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশু মজুত থাকত, তাহলে দাম অন্য বছরের তুলনায় কম হওয়ার কথা; কিন্তু সেটি বাস্তবে ঘটছে না।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। এর আগে কখনো দেশীয় উৎস থেকে এতসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশুর জোগান ছিল না।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ এইচ এম সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পশুর সরবরাহ বেশি থাকলে দাম বাড়ার কথা নয়; বরং কমে যাওয়ার কথা। সরকারি পরিসংখ্যানে যে সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে, তা কতটা সত্য, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

অন্যদিকে খামারিরাও বলছেন, পশু পালনের খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে পশুখাদ্যের দাম গত বছরের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে কোরবানির পশুর বাজারে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। এর আগে কখনো দেশীয় উৎস থেকে এতসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশুর জোগান ছিল না।

গবাদিপশুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুযায়ী, আকার ভেদে এবার জীবিত গরু প্রতি কেজি (লাইভ ওয়েট) ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে জীবিত পশুর (গরু) কেজি পড়ছে ৬৩০ টাকা পর্যন্ত। বিডিএফএ বলছে, গত বছর লাইভ ওয়েটে প্রতি কেজি গরুর দাম ছিল ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা। লাইভ ওয়েটে একটি গরুর যে ওজন হয়, কোরবানি দেওয়ার পর মাংস ও হাড়ের পরিমাণ হয় তার প্রায় ৫৫ ভাগ।

বিডিএফএর সভাপতি মো. ইমরান হোসেনের ‘সাদিক অ্যাগ্রো’ নামে ঢাকার বছিলায় খামার রয়েছে। সেই খামারে এবার কোরবানির জন্য ২ হাজার ১০০ পশু প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যার মধ্যে ১ হাজারের মতো পশু ইতিমধ্যে বিক্রি হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১ হাজার গরুর মধ্যে ৯০০টির মতো গরু ‘লাইভ ওয়েটে’ বিক্রি হয়েছে। কোনো গরুর ওজন ৬০০ কেজির (লাইভ ওয়েটে) বেশি হলে তা ‘সৌন্দর্যের’ ভিত্তিতে বিক্রি করা হচ্ছে।

গবাদিপশুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুযায়ী, আকার ভেদে এবার জীবিত গরু প্রতি কেজি (লাইভ ওয়েট) ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে জীবিত পশুর (গরু) কেজি পড়ছে ৬৩০ টাকা পর্যন্ত।

পশু কোরবানি: করোনার আগে-পরের চিত্র
গত আট বছরের কোরবানির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিবছর কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা বাড়ছিল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৮১ পশু কোরবানি দেওয়া হয়। করোনার সংক্রমণ দেখা দিলে ২০২০ সালে কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে পশু কোরবানির সংখ্যা আরও কমে (৯০ লাখ ৯৩ হাজারের কিছু বেশি) যায়।

অবশ্য ২০২২ সালে কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা কিছুটা বেড়ে হয় ৯৯ লাখ ৫৪ হাজার ৬৭২টি। সবশেষ গত বছর দেশে পশু কোরবানি দেওয়া হয় ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। কত পশু কোরবানি দেওয়া হচ্ছে, তার ভিত্তিতে বলা যায়, করোনা শুরুর আগে দেশে সাধারণ মানুষের যে আর্থিক অবস্থা ছিল, সেই জায়গায় এখনো যাওয়া সম্ভব হয়নি।

গত বছর কোরবানি দিয়েছিলেন, সীমিত আয়ের এমন ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের কেউ-ই কোরবানির জন্য এবার গতবারের চেয়ে বেশি খরচ করতে চান না। এর মধ্যে দুজন বলেছেন, কোরবানিতে এবার গতবারের চেয়ে বাজেট কম তাঁদের। এই দুজনের একজন বলেছেন, গত বছর ছোট আকারের একটি গরু ৮০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন তিনি। তখনই সেটা তাঁর কাছে চাপ হয়ে গিয়েছিল। এবার তাঁর বাজেট ৫০ হাজার টাকা। অন্য কারও সঙ্গে ভাগে কোরবানি দিতে চান না। যে কারণে এবার খাসি কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

সামনে দাম কিছুটা কমবে বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পশুর হাট পুরোপুরি জমে উঠলে এখন যাঁরা বাড়তি দাম চাইছেন, তাঁরাও দাম কমিয়ে দেবেন। কারণ, প্রথম দিকে দাম ধরে রাখার একটা প্রবণতা থাকে।

গত বছর কোরবানি দিয়েছিলেন, সীমিত আয়ের এমন ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের কেউ-ই কোরবানির জন্য এবার গতবারের চেয়ে বেশি খরচ করতে চান না।

রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে বিক্রি শুরু
আগামী সোমবার বাংলাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্‌যাপিত হবে। কোরবানির পশু বিক্রির জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এবার স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে মোট ২০টি হাট বসেছে। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৯টি হাট ও দক্ষিণে ১১টি। গতকাল এসব হাটে পশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে, যা চলবে ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত।

বিক্রেতারা বলছেন, গাবতলী পশুর হাট বাদে রাজধানীর অন্য হাটগুলোতে বেচাবিক্রি মূলত শুরু হবে শুক্রবার (আজ) থেকে। গতকাল গাবতলী, হাজারীবাগ, উত্তরার দিয়াবাড়ি ও মেরাদিয়া হাট ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক। এর মধ্যে গাবতলী হাটেই ক্রেতার সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। অন্য হাটের তুলনায় এখানে পশু বিক্রির সংখ্যাও অনেক বেশি। তবে দাম নিয়ে প্রায় সব ক্রেতাই তাঁদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।

গতকাল বিকেলে মেয়াদিয়া হাটে যান আইনজীবী মাহবুবুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর যে গরু মানুষ ১ লাখ টাকায় কিনেছে, এবার একই আকারের গরুর দামই চাওয়া হচ্ছে ২ লাখ টাকা। দুই ঘণ্টা হাটের এমাথা-ওমাথা ঘুরেও নিজের বাজেট অনুযায়ী পছন্দে গরু কিনতে পারেননি তিনি।

এর আগে গতকাল দুপুরে গাবতলী হাটে গিয়ে দেখা যায়, হাজারো ক্রেতার ভিড়। সেখানে কথা হয় শ্যামলী রিং রোড এলাকার বাসিন্দা আহাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ৯১ হাজার টাকায় ছোট আকারের গরু কিনেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গত বছর একই আকৃতির গরু তিনি ৭৮ হাজার টাকায় কিনেছিলেন।

গত বছর যে গরু মানুষ ১ লাখ টাকায় কিনেছে, এবার একই আকারের গরুর দামই চাওয়া হচ্ছে ২ লাখ টাকা। দুই ঘণ্টা হাটের এমাথা-ওমাথা ঘুরেও নিজের বাজেট অনুযায়ী পছন্দে গরু কিনতে পারেননি তিনি।

আইনজীবী মাহবুবুর রহমান
গাবতলী পশুর হাটের বেশির ভাগ অংশ এবার শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে ওপরে ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরপরও দুপুরের দিকে প্রচণ্ড গরমে হাটের ভেতরে টিকে থাকা অনেকের জন্যই কষ্টকর হয়ে পড়ছিল। এই গরু-ছাগলের পাশাপাশি উট, দুম্বা, মহিষ, ভেড়াও উঠেছে। এই হাটের বিক্রেতারা বলছেন, বড় আকারের গরুর দাম জিজ্ঞেস করেই ক্রেতারা চলে যাচ্ছেন, কিনতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাবতলী হাটে যেসব গরু বেশি বিক্রি হয়েছে, সেসব গরুর দাম এক থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে ছিল বলে হাট পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাড়ে চার লাখ টাকা দামের গরু এই হাটে বিক্রি হয়েছে।

গাবতলী হাটের গরু–মহিষের পাশাপাশির দুটি উট ও দুটি দুম্বা তুলেছেন বিক্রেতা আমজাদ হোসেন। পাকিস্তান থেকে আনা উট দুটির দাম তিনি চাইছেন ২৬ থেকে ২৮ লাখ টাকা।

বিক্রেতা আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতবারের চেয়ে এবার গরুর দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি। কেন দাম এত বেশি প্রথম আলোর এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশে সব জিনিসের দাম এখন বেশি।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/at5tsb840h