১৩ জুন ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসই অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ

ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস দীর্ঘায়িত হওয়াকে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক অস্থিরতা ও সঙ্কটাপন্ন অবস্থার কারণেই দেশীয় অর্থনীতির চলমান সঙ্কটকে দায়ী করা হচ্ছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধেও (জানুয়ারি-জুন) সঙ্কোচনমুখী মুদ্রা ও ঋণ নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণে জুনের প্রক্ষেপণ ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে মার্চ শেষে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১০.৪৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। তবে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির সিলিংয়ের (৭.৫০ শতাংশ) তুলনায় ২.২৩ পয়েন্ট বেশি। আর মূলত বর্ধিত পরিবহন ব্যয় ও অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্য সমন্বয়ে অনমনীয় প্রকৃতি এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রভাবক রূপে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি আলোচ্য ত্রৈমাসিকে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলেও আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বৃদ্ধির ফলে সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে ১৩০ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যায় প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ও মুদ্রার বিনিময় হার সংক্রান্ত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে অর্থনীতির সর্বশেষ এ চিত্র উঠে এসেছে।

মুদ্রা ও ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুদ্রা সরবরাহ (এম২) চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ আগের ত্রৈমাসিক শেষের ১৯০৯১.৪৮ বিলিয়ন টাকার তুলনায় ১.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৩৭২.৪২ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিক (ডিসেম্বর-২৩) এবং পূর্ববর্তী বছরের একই ত্রৈমাসিক (মার্চ-২৩) শেষে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ১.৭০ শতাংশ ও ১.১৮ শতাংশ। মুদ্রা সরবরাহের উৎসভিত্তিক বিষেশ্লণ হতে দেখা যায়, আলোচ্য ত্রৈমাসিক শেষে নিট বৈদেশিক সম্পদ ৬.৫০ শতাংশ হ্রাস এবং নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদ ২.৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বার্ষিক ভিত্তিতে মার্চ শেষে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৮.৯২ শতাংশ, যা জুন-২৪-এর লক্ষ্যমাত্রা ৯.৭০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির (৯.১৩ শতাংশ) তুলনায় সামান্য কম রয়েছে।

উল্লেখ্য, বার্ষিক ভিত্তিতে মার্চ-২৪ শেষে নিট বৈদেশিক সম্পদ ১৫.৬৬ শতাংশ হ্রাসের বিপরীতে নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদ ১৪.০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত নিট বৈদেশিক সম্পদের অধিক হ্রাসের কারণে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কম হয়েছে। মূলত রেমিট্যান্স অন্তঃপ্রবাহ বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় কমে এলেও লেনদেন ভারসাম্যের আর্থিক হিসাবে ঘাটতির সূত্রে নিট বৈদেশিক সম্পদ আলোচ্য সময়কালে হ্রাস পেয়েছে, যা প্রক্ষেপিত মাত্রার বিপরীতে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিক শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিক শেষের ১৯৭১২.২২ বিলিয়ন টাকার তুলনায় ৩.৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩৬৪.৪৯ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। বার্ষিক ভিত্তিতে মার্চ শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১২.১৪ শতাংশ, যা জুন-২৪-এর লক্ষ্যমাত্রা ১৩.৯০ শতাংশ ও মাচ-২৩ শেষের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ১৬.২১ শতাংশের তুলনায় বেশ কম রয়েছে।

অভ্যন্তরীণ ঋণের উপাদানভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ঋণের অধিক মাত্রায় প্রবৃদ্ধির ফলে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আলোচ্য সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি (১০.৪৯ শতাংশ) কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা (১০.০ শতাংশ) অতিক্রম করলেও সরকারি খাতে ঋণ হ্রাসের প্রেক্ষিতে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা এবং পূর্ববর্তী বছরের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির (১২.০৩ শতাংশ) তুলনায় কম হয়েছে । মোট অভ্যন্তরীণ ঋণে বেসরকারি খাতের অংশ মার্চ-২৩ শেষের ৭৯.৬৭ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে মাচ-২৪ শেষে ৭৮.৫০ শতাংশে দাঁড়ায়। অভ্যন্তরীণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনে গৃহীত সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি চলমান থাকলেও সহায়ক নীতি হিসেবে অধিকতর উৎপাদনমুখী খাত : কৃষি, আমদানি বিকল্প খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ অব্যাহত রাখার প্রয়াসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে গৃহীত সরকারের ক্রমপুঞ্জীভূত নিট ঋণ স্থিতি পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের তুলনায় ১১.০২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে তিন লাখ ৯০ হাজার ৪০১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের ত্রৈমাসিক শেষে ৫.১৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। বার্ষিক ভিত্তিতে মার্চ শেষে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে গৃহীত সরকারের ক্রমপুঞ্জীভূত নিট ঋণ স্থিতি ২০.২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের বছরের মার্চ শেষে ৩৭.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সময়সীমা প্রায় শেষপর্যায়ে হওয়ায় এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার গৃহীত কৃচ্ছ্রতা নীতির কারণে বার্ষিক হিসাবে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারি খাতে (নিট) ঋণ অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে নিট বৈদেশিক সম্পদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, আলোচ্য ত্রৈমাসিক শেষে ব্যাংক ব্যবস্থার নিট বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণ পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের তুলনায় ৬.৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দুই লাখ ৫৯ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকে এবং পূর্ববর্তী বছরের একই ত্রৈমাসিক শেষে এ হ্রাসের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫.৪১ এবং ৩.৬৯ শতাংশ।
বার্ষিক ভিত্তিতে মার্চ-২৪ শেষে নিট বৈদেশিক সম্পদ ১৫.৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা চলতি জুনের প্রক্ষেপিত পরিমাণের (২.৪০ শতাংশ হ্রাস) চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী বছরের একই সময় (মাচ-’২৩ শেষে) নিট বৈদেশিক সম্পদের হ্রাসের হার ছিল ১৩.৬৯ শতাংশ।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/842407