১০ জুন ২০২৪, সোমবার, ১২:৫২

অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ দিতে নানা তৎপরতা

মহেশখালীতে অবস্থিত দেশের অন্যতম বড় মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের কার্যাদেশ নিয়ে শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) বিরুদ্ধে অভিযোগ-দরপত্র প্রক্রিয়ায় বাতিল হওয়া (অযোগ্য) একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে চলছে নানা তৎপরতা। সম্প্রতি দরপত্র প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দিয়েছে দরপত্রে অংশ নেওয়া একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম। বিদ্যুৎ বিভাগ এ ঘটনায় দ্রুত দরপত্র মূল্যায়নে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট মতামত দিতে সিপিজিসিবিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদকে চিঠি দিয়েছে।

রোববার বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্মসচিব তাহমিনা বেগম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য আমদানিকৃত কয়লা সংগ্রহ ও বিতরণে দাখিলকৃত দরপত্র অবমূল্যায়িত হয়েছে এবং বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট কর্তৃপক্ষের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে-এ মর্মে একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম অভিযোগ করেছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত মতামত দেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

এ বিষয়ে জানতে রোববার সিপিজিসিবিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদকে একাধিকবার টেলিফোনে কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

এদিকে বৃহস্পতিবার দরপত্র প্রক্রিয়ায় বাতিল হওয়া একটি কোম্পানি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব বরাবর পাঠানো এক অভিযোগপত্রে বলে, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেওয়া চারটি কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন না করেই সবাইকে রহস্যজনকভাবে বাতিল ঘোষণা করে। অভিযোগে আরও বলা হয়, বাতিলকৃত একটি আর্থিক প্রস্তাবকে কৌশলে পুনর্বহাল করার জন্য সংস্থার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও বোর্ড সদস্য কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, গোপনে ওই কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য বেশকিছু অত্যাবশ্যকীয় শর্তও শিথিল করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৫ জুন বিকালে ওই কোম্পানির সঙ্গে একটি নেগোসিয়েশন বৈঠকও করে সিন্ডিকেট।

খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও এ ঘটনায় কয়লা আমদানির দরপত্র প্রক্রিয়ায় আদর্শ মান বজায় রাখা হয়নি বলে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। এপ্রিলে আইএমইডি মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কয়লা আমদানির দরপত্র প্রক্রিয়ায় আদর্শ মান বজায় রাখা হয়নি জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর এ চিঠি দেয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে-সরকারি নিরীক্ষণ প্রতিবেদন উপেক্ষা করে পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মহেশখালীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন চলতি মাস থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। জাপানের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত দুই ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পর দ্বিতীয় ইউনিটও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে। গত বছর ২৪ ডিসেম্বর থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলেও প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে একই মাসের ২৬ তারিখ থেকে।
দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি চার প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করলেও ‘আর্থিক সক্ষমতা নেই’ অজুহাতে প্রথমেই তিন প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ২৭ মে কারিগরি কমিটির সভায় চারটি কনসোর্টিয়ামের সবকটির আর্থিক প্রস্তাব বাতিল হয়। সর্বশেষ ৩১ মে সিপিজিসিবিএল-এর বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় বাতিলকৃত একটি কনসোর্টিয়ামকে নিয়ে সমঝোতা করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
অপর তিন কনসোর্টিয়ামের একটি ২৯ মে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে দরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করে। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জুন বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত দরপত্র মূল্যায়নে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট মতামত প্রদানের জন্য সিপিজিসিবিএলকে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ।

দরপত্রের প্রাথমিক শর্তানুযায়ী, কমপক্ষে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল, যা কয়লা আমদানিসংশ্লিষ্ট দরপত্রের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য ওই শর্তটি শিথিল করে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট অথবা খাদ্যশস্য আমদানির অভিজ্ঞতাকে যোগ্যতা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাতিল হওয়া কোনো একক কোম্পানির সঙ্গে যদি নেগোসিয়েশন করা হয়, তাহলে সেটি ক্রয় নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও বাতিল করা কোম্পানির সঙ্গে এমন নেগোসিয়েশন গ্রহণযোগ্য নয় বলেও মনে করেন টিআইবির প্রধান।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, যে কোনো কারণেই বাতিল হোক না কেন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাতিলকৃতদের মধ্য থেকে এক প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবে বৈধ করার এখতিয়ার নেই।

https://www.jugantor.com/index.php/todays-paper/last-page/814970