৯ জুন ২০২৪, রবিবার, ৪:২১

কোটি টাকা ব্যয়ে ফল মেলার অর্জন নিয়ে প্রশ্ন

ছিল না চাষি-উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ : চেইন শপের স্টলও ছিল মেলায়

দেড় কোটি টাকা খরচ করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা উপজেলায় ‘ধুমধাম’ করে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় ফল মেলা। ‘ফলে পুষ্টি অর্থ বেশ, স্মার্ট কৃষির বাংলাদেশ’- এই প্রতিপাদ্যে রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) চত্বরে গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী জাতীয় ফল মেলা শেষ হয়েছে গতকাল শনিবার। কৃষি উদ্যোক্তা, ফল চাষি, রফতানিকারক ও বাজারজাতে জড়িত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ মেলা হওয়ার কথা থাকলেও ফার্মগেট, কাওরানবাজার, মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকার ফল দোকানিরা পান স্টল বরাদ্দ। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৬৩টি স্টলের মধ্যে হাতেগোনা চার-পাঁচজন উদ্যোক্তা ছাড়া দেশের ফল চাষিদের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি এ মেলায়। চাষি-উদ্যোক্তাদের সাথে রফতানিকারকদের সংযোগ স্থাপনই ছিল মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু মেলায় প্রকৃত চাষি কিংবা উদ্যোক্তাদের দেখা পাওয়া না গেলেও রাজধানীর বিপণিবিতানের মালিকদের পোয়াবারো হয়েছে। যে আম দোকানে ১২০ টাকায় বিক্রি করছিলেন এত দিন, সেই আমই দেড় শ’ টাকায় বিক্রি করেছেন তারা। সরেজমিন দেখা গেছে, মেলার প্রবেশমুখের বড় স্টলগুলোর সবই সরকারি প্রতিষ্ঠানের। ভেতরে ছোট স্টলগুলো রাজধানীর ফল দোকানিদের। একাধিক স্টলে ফলের পরিবর্তে স্থান পায় লাড্ডু, কেক, চানাচুরসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার। ফলের মধ্যে আমই ছিল সবচেয়ে বিশ। এক সময়ের জনপ্রিয় বিলুপ্তপ্রায় ফলগুলোর তেমন জায়গা হয়নি মেলায়। সাধারণ দোকানিদের পাশাপাশি আগোরার মতো চেইন শপও স্টল বরাদ্দ পায় মেলায়। মেলার ভেতর এক প্রান্তজুড়ে বিভিন্ন স্টলে দেখা যায় মাশরুম পণ্যের সমাহার।

বিভিন্ন জাতের আম নিয়ে স্টল সাজানো বিসমিল্লাহ ফল ভাণ্ডারের বিক্রেতা জানান, ‘এখানে (মেলা) নিজস্ব বাগানের কেউ ফল আনেনি। যদি কেউ বলে তার (লেখার অযোগ্য) নেই। সব ব্যবসায়ী-দোকানদার।’ শেরেবাংলানগর তালতলার ষাটোর্ধ্ব এই দোকানি জানান, কোনো বাগান মালিক এখানে আসেনি। তারা আসলে তো এভাবে আম বিক্রি করবে না। সাজিয়ে বসে থাকবে। এখানে সবাই তো বিক্রি করছে মানে কারো নিজস্ব বাগানের ফল নয়।

মণিপুরীপাড়ার ভাই ভাই ফল বিতানের মালিক মো: রিপন বিনামূল্যে মেলায় স্টল পেয়ে নানা রকমের ফল নিয়ে এসেছেন। বেচাবিক্রি বেশ ভালো। দোকানের চেয়ে প্রতি কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান। ফার্মগেটের ইন্দ্রিরা রোডের মায়ের দোয়া ফল ভাণ্ডারের মো: সুমনের মতে, কৃষি কর্মকর্তারা বিনামূল্যে মেলায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখানে দামও ভালো পাওয়া গেছে। ফল মেলা ঘুরে কোনো স্টলেই উৎপাদক, উদ্যোক্তা কিংবা রফতানিকারককে পাওয়া যায়নি। অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষি বিজ্ঞানীদের অনেকেই হতাশ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, যেখানে চাষি নেই, উদ্যোক্তা নেই এত টাকা খরচ করে ফল মেলা করে অর্জনটা তাহলে কী?

হতাশার কথা জানিয়েছেন দর্শনার্থীরাও। মিরপুরের আবুল কালাম, তেজগাঁওয়ের আসাদুর রহমান ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, মেলায় আসলাম রাসায়নিকমুক্ত ফল কিনতে কিন্তু বেশির ভাগই মনে হলো সাধারণ দোকানে যেসব আম বা অন্যান্য ফল পাওয়া যায় সে রকমই। ভিন্নতা খুব বেশি পাওয়া যায়নি। পার্থক্য শুধু যে, এসির মধ্যে স্টল থেকে ফল কেনা।

জানা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য সফল কৃষি উদ্যোক্তা রয়েছেন। এ মেলায় তাদের আনার বিষয়ে তেমন জোর দেননি সংশ্লিষ্টরা। ডিএইর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, মেলার বেশির ভাগ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন হর্টিকালচার উইং ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক। এবারের মতো চাষি ও উদ্যোক্তাবিহীন ফল মেলা এর আগে হয়নি বলে বলছিলেন মেলা প্রাঙ্গণে আসা একাধিক কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ফল উৎপাদক ও বাজারজাতের সাথে জড়িতদের উৎসাহিত করতেই ফল মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের উৎপাদনকারীদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। উৎপাদনকারী অনেকেই হয়তো এখন তাদের বাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি।

গত বৃহস্পতিবার তিন দিনব্যাপী জাতীয় ফল মেলার উদ্বোধন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আবদুস শহিদ। গতকাল সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও বর্তমান কৃষি মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক।
জাতীয় ফল মেলা সফল করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সফলভাবে এ মেলা সম্পন্নের জন্য এক কোটি ৫১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর মধ্যে ৬৪ জেলায় ১২ হাজার টাকা করে মোট সাত লাখ ৬৮ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। আর উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ রাখা হয় সাত হাজার টাকা করে মোট ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। বাকি প্রায় কোটি টাকার উপরে খরচ করা হয় ঢাকার প্রধান ফল মেলায়। এর মধ্যে মেলা উদযাপন বাস্তবায়ন উপকমিটির জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৫০ লাখ টাকা। প্রচার প্রকাশনা যেমন- ফল মেলা উপলক্ষে পোস্টার, ব্যানার তৈরি টাঙ্গানো খাতে খরচ করা হয়েছে ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। কৃষি তথ্য সার্ভিস এ খরচ করেছে।

এ দিকে কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফল মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক এমপি প্রধান অতিথি থেকে মেলায় অংশগ্রহণ ও ফল উৎপাদনে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে পুরস্কার বিতরণ করেন। মেলায় স্টল প্রদর্শনীর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ১ম স্থান অধিকার করে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ২য় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ৩য় স্থান অধিকার করে। বেসরকারি পর্যায়ে ঋধৎসর অমৎড় ১ম স্থান, চিটাগাং মেরিডিয়ান এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২য় স্থান এবং কাফকো এগ্রো ৩য় স্থান অর্জন করে। ফল উৎপাদন ও বাণিজ্যিকীকরণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে মো: সোহেল রানা, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও মো: হারুন অর রশিদকে (মুসা) পুরস্কৃত করা হয়। ফল উৎপাদন ও সম্প্রসারণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রহিম এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো: এনামুল হককে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/841417