বাজারে রসুন, আদা, ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অত্যন্ত চড়া। এই ৫টি পণ্য ছাড়াও প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই কমবেশি বাড়তি। যে কারণে বাজারে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাজার খরচ বেড়ে যাওয়ায় নি¤œ ও মধ্যম-আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। তবে বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। যে কারণে

বাজারেও বাজেটের কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। অন্য বছরের মতো প্রস্তাবিত বাজেট পেশের পরই নিত্যপণ্যের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবজি, মাছ-মাংসসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক পণ্য আগের কেনা রয়েছে তাই বাজেটের প্রভাব বুঝতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে, তবে অনেক নিত্যপণ্যের দাম ইতিমধ্যেই বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর মান্ডা-মুগদা ও মালিবাগ-মগবাজার এলাকা ঘুরে নিত্যপণ্যের বাজারের এই চিত্র দেখা গেছে।

এদিন বাজারে দেখা যায়, প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। হালি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। আর একটি ডিমের দাম নেওয়া হচ্ছে ১৪ টাকা। এ দাম প্রায় বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। আদা মানভেদে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, রসুন ২৪০ থেকে ২৬০ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বাজারের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সবজি আলু। গত বছর থেকে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এখন বাজারে প্রতি কেজি আলু ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগেও ৫৫ টাকা ছিল। এছাড়াও ভারত থেকে আমদানির সুযোগ থাকলেও দেশে প্রতিদিন বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।

গত এক সপ্তাহে কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ৭০ টাকা ছিল। এদিকে বাজারে বিভিন্ন সবজিসহ তেল, চিনি ও আটার মতো অন্যান্য নিত্যপণ্য চড়া দামে আটকে রয়েছে।

মালিবাগ বাজারের আলু বিক্রেতা মজনু মিয়া বলেন, এ বছর আর আলুর দাম কমবে না, বরং দিন দিন আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। কারণ কোল্ড স্টোরেজ থেকেই আলু প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে, যা পাইকারি বাজারে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজেও এবার খুব বেশি আলু নেই। যদি ভারত থেকে আমদানি না হয় তাহলে মৌসুম শেষে দাম আরও বাড়বে। তবে আমদানি হলে দাম কিছুটা কমতে পারে। কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, কুরবানির ঈদ সামনে রেখে বাজারে পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। যে কারণে হু হু করে দাম বাড়ছে। ঈদের আগে দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ থাকলেও ওই দেশ ন্যূনতম রপ্তানিমূল্য ৫৫০ ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছে। শুল্ক-করসহ এ পেঁয়াজ দেশে আনতে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা খরচ হয়। যে কারণে কেউ পেঁয়াজ আমদানি করছে না। এতে বাজার শুধু দেশী পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করেই চলছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রমযান মাস থেকেই মূলত দ্রব্যমূল্যের বাজার ঊর্ধ্বগতির দিকে। তাছাড়া বাজেট ঘোষণার আগেই অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য ঘোষণার পর পণ্যের দাম বাড়ার আর কিছু থাকে না। তারপরও কিছু জিনিসে এর প্রভাব পড়তে পারে, যা হয়তো আগামী সপ্তাহের বাজারে দেখা যাবে। সবজির বাজারে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মতো এই দিনেও বাজার অনেকটা উত্তপ্ত। প্রায় অধিকাংশ সবজিই বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। বাজারে কিছু সবজি আছে যেগুলো মানভেদে বিক্রি হচ্ছে সর্বনি¤œ ৪০ টাকার মধ্যে।

মান্ডা বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. সামছুল হক বলেন, আজকের বাজারে পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা, যা পূর্বে ছিল ৬০ টাকা। বরবটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, যা ছিল ৮০ টাকা। গাজর ১২০ টাকা, যা ছিল ১৬০ টাকা। শসা বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই ৮০ টাকা। এছাড়াও ঢ্যাঁড়স ৫০ টাকা, যা গতকালও বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা। প্রতিকেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। এছাড়াও বেগুন বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৮০ থেকে ৬০ টাকা। তিনি বলেন, টমেটোর সিজন শেষ হয়ে যাওয়ায় টমেটোর দামটা দিন দিন বাড়ছে। আজকের বাজারে টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। কচুর লতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা এবং কচুর মুখি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০০ টাকা করে।

বাজেটের প্রভাব বিষয়ে এই বিক্রেতা বলেন, বাজার আগের চেয়ে দাম একটু বেশি। গত বৃহস্পতিবার বাজেট পেশের পরই বাজারে কোনো প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সবজির দাম তো এমনিতেই তুলনামূলক বেশি, এখানে আর কী দাম বাড়বে। তারপরও হয়তো আগামী সপ্তাহের বাজারে আসল চিত্র বোঝা যাবে। এছাড়াও মসলার দাম আরও বাড়বে। আরেক সবজি বিক্রেতা সায়েদুল ইসলাম বলেন, কিছু জিনিসের দাম শুক্রবার এলে এমনিতেই বেড়ে যায়। যেমন, শসা, টমেটো আর গাজর শুক্রবার আসলে এই জিনিসগুলোর চাহিদাও বাড়ে, দামও বাড়ে। অন্যান্য সবজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দামটা একটু বাড়তি। গরম কমলে সামনে দাম কিছুটা কমতে পারে।

এদিকে বাজার করতে আসা মওদুদ আহমেদ বলেন, গতকাল বাজেট হয়েছে দেখলাম, যদিও বাজেটের সাথে আমাদের মতো শ্রেণিপেশার মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ধরনের বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু থাকে না। বাজেট কম হোক বা বেশি হোক, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কখনোই কমবে না বরং উল্টো বাড়তেই থাকবে। যে কারণে বাজেটকেন্দ্রিক খুব বেশি একটা আগ্রহ নেই। তিনি বলেন, বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যেরই দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে কারণে মাসের খাবার খরচ বেড়েছে প্রায় অর্ধেক। কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়েনি। ২টা টিউশনি করিয়ে আগে যা পেতাম, এখনও তাই পাই। কিন্তু যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে, তাতে আমাদের মতো মানুষদের কিছুই কিনে খাবার উপায় নেই। জসিম উদ্দিন নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, আমাদের স্বল্প বেতনে প্রতিদিন মাছ বা মাংস খাওয়া যায় না। কিন্তু সবজির দামও যদি এমন বাড়তি যায় তাহলে এটা খাওয়াও কমিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, বাজারে সব ধরনের সবজিতে ভরপুর। কোনো সংকট নেই। তারপরও ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। আমরা আসলে যাবো কোথায়? এভাবে একটা দেশ চলতে পারে?

প্রসঙ্গত, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দেশের ইতিহাসের ৫৪তম বাজেট এটি। এর আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এজন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে অন্তত ২৭টি প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানো হচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলসহ ২৭ পণ্য।