৬ জুন ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৩৩

শুল্ক বাড়ছে অর্ধ শতাধিক পণ্যে

কর অব্যাহতি ও শুল্ক ছাড় হ্রাস, ভ্যাট ও করের আওতা বাড়ছে

আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে অর্ধশতাধিক পণ্যে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন, গম, ভুট্টা, সরিষাবীজ, তুলাবীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, পেনিসিলিন, ইনসুলিন, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক কয়েল, পেপার বোর্ড, স্টিল জাতীয় পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। শুল্ক আরোপের ফলে এসব পণ্যের জন্য মানুষকে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে। পাশাপাশি বাড়ছে ভ্যাট ও করের আওতা। সেই সাথে ভ্যাটের হার বাড়বে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে বেশি হারে ভ্যাট দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতে ভ্যাট অব্যাহতি কমবে। ছোট-বড় শতাধিক শিল্প খাতে রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা বাতিল হবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। এ দিকে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরও করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। আইএমএফের সুপারিশে অনেক খাতে নতুনভাবে ভ্যাট বসবে।

আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর জন্য রাজস্ব আয়ের বিশাল অঙ্ক পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। বাকি দুই লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত পরিপূরণে রাজস্ব আয় বাড়াতে এবার কর অব্যাহতি, কর ছাড় কমানো হচ্ছে। অর্ধশতাধিক পণ্যের শূন্য শুল্ক তুলে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার তালিকা বড় হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের দিক থেকে আগামী অর্থবছরে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের রাজস্ব বাড়ানোর শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর সংগ্রহ ৮ শতাংশের কম। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে কর-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। আর এ কারণেই রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণ, কর প্রশাসনের সংস্কার ও আদায় প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। গত নভেম্বরে এনবিআরের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ‘প্রত্যক্ষ কর ব্যয়’ বলতে রেয়াত, ছাড়, অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা থেকে আয় বাদ দেয়াকে বোঝায়। এনবিআর এবারই প্রথম আগামী বাজেটে কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় কমিয়ে অন্তত বাড়তি ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের কৌশল নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শূন্য শুল্কের অর্ধশতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর থেকে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে। বর্তমানে আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই এমন পণ্যের সংখ্যা ৩২৯টি। এ তালিকায় আছে খাদ্যপণ্য, সার, গ্যাস, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি। এর মধ্যে ৫০টিরও বেশি পণ্যে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হচ্ছে। এতে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। তৈরী পোশাক, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স, পোলট্রি ও ফিশারি খাতেও কর ছাড় কমানো হতে পারে। নতুন বাজেটে ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে নিরাপত্তাসেবা প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এখন এ ধরনের নিরাপত্তা সেবা নিলে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।

নতুন ভ্যাট আইনে ১৫ শতাংশকে আদর্শ ভ্যাটহার ধরা হলেও নানা কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ জন্য একাধিক হারে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। আগামী বাজেটে এ হার কিছুটা যৌক্তিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। ২০২৬ সাল নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কর ব্যতীত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) বাড়াতে আগামী বাজেটে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারা মূল্য কিছুটা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে জমির নামজারির মাশুলও (ফি)। মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করে, সেগুলোর পরিমাণও বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। এ ছাড়া উড়াল সড়ক, এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন সেতু পারাপারের টোল, সেবা ও প্রশাসনিক মাশুল বাড়ানো হতে পারে।

মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর বাড়তি ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড বিক্রির ওপর কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা হতে পারে। বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, আমসত্ত্বের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর আরও ২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে।
প্রতিবারের মতো আগামী বাজেটেও সিগারেট উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য স্তর বাড়ানো হচ্ছে। তাই সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে। দেশে কাজুবাদাম চাষকে সুরক্ষা দেয়ার অংশ হিসাবে খোসা ছাড়ানো কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। গরমে স্বস্তি পেতে অনেকে এয়ারকন্ডিশন বা এসি কিনছে। আগামী বাজেটে এসিকে বিলাসী পণ্য বিবেচনা করে দেশে এসি উৎপাদনে ব্যবহৃত কম্প্রেসার ও সব ধরনের উপকরণের শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। তাই এসির দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। দেশে উৎপাদন হওয়ায় পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টারের দাম বাড়তে পারে। বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ে অনেকে এলইডি বাল্ব ব্যবহার করেন। নিকট-ভবিষ্যতে এলইডি বাল্বের দাম বাড়তে পারে। কারণ এলইডি বাল্ব এবং এনার্জি সেভিং বাল্ব উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সন বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব আদায় বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছে এনবিআর। গাড়ি সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সনের ব্যবহৃত কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এ কারণে গাড়ি কনভার্সন খরচ বাড়তে পারে। আবার লোডশেডিং মোকাবেলায় বাসাবাড়ি বা শিল্পে জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ছে। সেখানেও নজর দিয়েছে এনবিআর। জেনারেটর সংযোজন ও উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ বা যন্ত্রাংশ আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। তাই দেশের বাজারে জেনারেটরের দাম বাড়তে পারে।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ইলেকট্রনিক্স পণ্য খাতকে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এসি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। এর মেয়াদ আর না বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে পারে। ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এলইডি বাল্ব, টিউব লাইট, তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্যেও বাড়তে পারে ভ্যাট। এ সব খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে তাদের পরিচালন ব্যয় বাড়বে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে বাড়তি ব্যয়ের ভার ভোক্তাদের ওপরই চাপবে। কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতাল শুল্কছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ রয়েছে। আগামী বাজেটে ২০০টিরও বেশি মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে, যা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। একটি হাসপাতালকে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতাল হতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। সরকার নির্ধারিত শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মনো-ডিসিপ্লিনারি বা ন্যূনতম ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি হতে হবে। আন্তর্জাতিক মান পূরণ করে রোগীদের জন্য উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতাও থাকতে হবে।
দেশের প্রধান রেফারেল হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে বারডেম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, অ্যাপোলো হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার মহিলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ, ইব্রাহিম ইকবাল মেমোরিয়াল হাসপাতাল, জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, সালাউদ্দিন বিশেষায়িত হাসপাতাল, আদ্-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ডেল্টা হাসপাতাল এবং ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতাল।

রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ থেকেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। অন্য দিকে বিত্তশালীদের কাছ থেকেও বাড়তি কর আদায়ের পদক্ষেপ থাকছে। বর্তমানে বার্ষিক আয় সাড়ে ১৬ লাখের বেশি হলে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে করহার রাখা হচ্ছে ২৫ শতাংশ। তবে এর বেশি আয়ের ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ‘ক্যাপিটাল গেইন’ কর আরোপের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। করের আওতা বাড়াতে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া আরও কিছু সেবায় রিটার্ন জমার সনদ প্রদান বাধ্যতামূলক হতে পারে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/840680