৬ জুন ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৩২

উপকূলের ৫৩ শতাংশ কৃষি জমি পতিত পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকার ৫৩ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, কৃষি ব্যবস্থাপনা, মিঠা পানির মাছ ও বন্যপ্রাণী। আশংকা করা হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের। লবণাক্ততা বৃদ্ধির পিছনে যেমন প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট দু’বিষয়কেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেই মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এদিকে, আশঙ্কাজনকহারে লবণাক্ততা বাড়ায় দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি অধিবাসীরা রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে লবণাক্ততা প্রতিরোধে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার ১৪৮টি উপজেলার মধ্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ১০টি উপজেলার নদীর পানি। এগুলো হলো- খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাট জেলার মোংলা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া। এ সব উপজেলায় এখন ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। আগামীতে তা ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে বঙ্গোপ সাগরের নোনা পানির প্রভাব এলাকার প্রকৃতির ওপর পড়ছে। কিন্তু চিংড়ি ঘেরের কারণে মানবসৃষ্ট কৃত্রিমভাবে গ্রামগঞ্জের মাটিও লবণাক্ত হচ্ছে।

সূত্র আরও জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৩২ শতাংশ ভূমিতে বসবাস করছে প্রায় চার কোটি মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ। এ অঞ্চলের মাত্র ৩০ শতাংশ জমি এখন চাষযোগ্য। এছাড়া ১৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে মাছ চাষসহ অন্যান্য কাজে। ৫৩ শতাংশ জমি পতিত রয়েছে শুধু লবণাক্ততার কারণে। চাষযোগ্য ৩০ শতাংশ জমি আবার পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে স্থানীয়রা। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল এ্যাকশনের এক গবেষণায় জানা যায়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের জেলা-বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি আনতে স্লুইসগেট ছিদ্র করে বাঁধ দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে এসব এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতার।

দক্ষিণাঞ্চলে লবণ প্রধানত দুইভাবে ছড়াচ্ছে। সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয়ে ও মাটির নিচের স্তর থেকে ওপরে ওঠে এসে। মার্চ ও এপ্রিলে জোয়ারের পানি এসে দক্ষিণাঞ্চলে যেসব আবাদি জমি তলিয়ে যায়, সে সব মাটিতে লবণ ছড়িয়ে পড়ে। এ পানিতে ক্ষতিকর মাত্রার লবণ থাকে। এ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হলে মাটি লবণাক্ত হয়। এছাড়া খুলনার সুন্দরবনের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যা ত্রিভূজাকৃতির বঙ্গোপসাগরের শীর্ষ বিন্দুতে গাঙ্গেয় মোহনায় অবস্থিত। এই গাঙ্গেয় মোহনার মহীঢাল খুব মসৃণভাবে সমুদ্রে নেমে গেছে। ফলে আন্দামান সাগরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড়গুলোর উত্তরমুখী যাত্রায় মহীঢালের অগভীরতার কারণে জলোচ্ছ্বাস অত্যন্ত উঁচু হয়ে আসে। সাগরের জোয়ারও অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়। তাই সাগরের লোনাপানি ঢুকে পড়ে উপকূলভাগে, লবণাক্ত করে তোলে ভূ-অভ্যন্তরের পানিও।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বন্ধে পাকিস্তান আমল থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বেড়িবাঁধ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সিডর ও আইলার পর অনেক স্থানেই সেই বাঁধ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য অনেকে বাঁধ কেটে ঘের এলাকায় লবণপানি ঢুকিয়ে থাকেন। এতে গুটিকয়েক চিংড়িচাষি লাভবান হলেও এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দার জীবন-জীবিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

উপকূলীয় জেলাগুলোতে এখন খাবার পানির মারাত্মক সংকট চলছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে পুকুরের মতো মিঠা পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে এবং টিউবওয়েলেও পানি দিন দিন কমে আসছে। লবণাক্ত ও দূষিত পানি ব্যবহার করার ফলে বেড়ে যাচ্ছে ডায়েরিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, ইউরিন্যাল ইনফেকশন, চর্মরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, যৌনাঙ্গে চুলকানি, ঘা-এর মতো রোগের প্রকোপ। নারীদের মধ্যে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিচ্ছে, যা পরবর্তীতে রূপ নিচ্ছে টিউমার এবং জরায়ু ক্যান্সারের মতো রোগে। চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন ও সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে আরও বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকালগর্ভপাতেরই শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়। এ ছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। উপকূলীয় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মার্চ ও এপ্রিলে অনেক জায়গাতেই খাবার পানির তীব্র সংকট ছিল। খুলনার কয়রা ও দাকোপ, সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ এবং বরগুনা জেলার পাথরঘাটায় কম বৃষ্টিপাতের ফলে সেখানকার পানির স্তর হ্রাস পেয়েছে। এ অঞ্চলের অনেক পরিবার পুকুরের মতো উৎস থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করে। অপরিষ্কার ও দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে এসব পরিবারের অনেক নারী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

এদিকে, দেশের আবাদি জমির শতকরা ১০ ভাগের বেশি দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায়। এ দেশের উপকূলবর্তী এলাকার ২৮.৬০ লাখ হেক্টরের মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর আবাদি জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত। এর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলার অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। জমিতে লবণাক্ততার কারণে এ এলাকায় বর্ষাকালে শুধু আমন ধানের উৎপাদন ছাড়া সারা বছর পতিত থাকে, কারণ এলাকায় জমিতে জো আসে ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে। শুষ্ক মওসুমে মিষ্টি পানির অভাবের কারণে বোরো ধান আবাদ করা সম্ভব হয় না।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউেটটের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (রুটিন দ্বায়িত্ব) জি, এম, মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার মধ্যে বর্তমানে খুলনার কয়রার শিপসা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনির মরিচ্চাপ নদীতে লবণাক্তার পরিমাণ বেশি। এছাড়া উল্লিখিত তিনটি জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে লবণাক্তার পরিমান ভিন্ন ভিন্ন। ফলে নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষি জমিতেও তার প্রভাব পড়ছে। ‘উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার সমস্যা ও উন্নয়ন সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় দু’টি প্রাকৃতিক কারণে। এক- জোয়ারের সময় লবণযুক্ত পানি জমিতে প্লাবিত হয়ে; দুই- ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি কৈশিক রন্ধ্র দিয়ে মাটির উপরে চলে আসা। সাধারণত শুকনো মওসুমে (মার্চ-মে) লবণাক্ত জোয়ারের পানিতে বহু জমি তলিয়ে যায়। তখন লবণাক্ত পানি জমিতে ছড়িয়ে যায়। এ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হলে মাটি বা জমি লবণাক্ত হয়। অন্যদিকে বর্ষা শেষ হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস হতে মাটি শুকাতে শুরু করে। এর ফলে মাটিতে অনেক ফাটল সৃষ্টি হয়। যখন মাটির উপরে রোদ পড়ে তখন মাটির উপরিস্তর হতে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে চলে যায় এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি ঐ ফাটল দিয়ে ভূমির উপরিস্তরে চলে আসে। তখন জমির উপরিস্তর লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া মনুষ্য সৃষ্ট কারণেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। যেমন, উপকূলীয় অনেক এলাকায় মৎস্য চাষিরা লবণ পানির ঘের তৈরি করে চিংড়ি চাষ করে। এতে করে ঐসব ঘেরের মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ততার কারণে উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়, ফুলের সংখ্যা হ্রাস পায়, অনেক ক্ষেত্রে পরাগায়নও হয় না। ফলে ফসলের ফলন বিভিন্ন মাত্রায় কমে যায়। মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে মৃত্তিকা দ্রবণের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক বেশি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে।

গবেষণায় লবণাক্ত এলাকার কৃষিতে বিপ্লব আনয়ন সম্ভব- উল্লেখ করে বলা হয়, লবণ সহিষ্ণু ফসল ও জাতের উদ্ভাবন এবং আধুনিক চাষ প্রযুক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। ভুট্টা একটি লবণসহিষ্ণু ফসল। তাই, কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে স্থানীয় জাতের ধানের পরিবর্তে স্বল্প মেয়াদি আধুনিক জাতের বা হাইব্রিড জাতের ভুট্টা আবাদ করা যেতে পারে। লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ত সহনশীল ফসল যেমন সূর্যমুখী, রেড বিট, সয়াবিন ইত্যাদি চাষাবাদ করতে হবে। এছাড়া ঘেরের পাড়ে প্রায় সারা বছর সবজি ও তরমুজ চাষ করা যেতে পারে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউেটর সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ বিধান কুমার ভান্ডার বলেন, দক্ষিণ অঞ্চলের লবণাক্ত কবলিত জমির লবণাক্ততা কমাতে হলে লবণ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। পোল্ডার ব্যবস্থাপনাসহ স্লুইসগেট ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ করতে হবে। সর্বোপরি মাটি ও পানির লবণাক্ততা বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

https://www.dailysangram.info/post/558134