৫ জুন ২০২৪, বুধবার, ৩:১৫

ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারিবারিক মূল্যবোধে চূড়ান্ত আঘাত

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে- শেষ

আমাদের সন্তানদের মৌলিক অধিকার শিক্ষার মাধ্যমে এবার ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিরাচরিত পারিবারিক মূল্যবোধে চূড়ান্ত আঘাত করা হয়েছে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার নানামুখী কর্র্মতৎপরতা পরিচালনা করলেও সরকারের ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকা একটি গোষ্ঠী সুকৌশলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবতা বিবর্জিত ও কিছু বিতর্কিত বিষয় যুক্ত করে প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার চক্রান্ত করছে।

প্রকৃত অর্থে সরকারকে বিতর্কিত করতেই মূলত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটিতে কিছু লোকের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আমাদের শিশুদের পাঠ্যবইয়ের মাধ্যম বিকৃত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। শিশুরা যেখানে ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করতে পারে না, সেখানে তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়া গুরুতর অপরাধেরই নামান্তর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে সরকারকে এদেশের জনগণের সামনে ইসলামবিরোধী এবং হিন্দুত্ববাদী হিসেবে পরিচিত করাই যেন এই চক্রের উদ্দেশ্য।

২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এবং চলতি ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্যও প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমে যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে সেখানে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব পাঠ্যপুস্তকে যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেখানে শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলমানই নয়, বরং যেকোনো ধর্মের সুস্থ চিন্তাধারার মানুষের নজরেও বিতর্কিত বিষয়গুলো খুবই বড় আকারে ধরা পড়বে। বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকাতেই ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ন্যক্কারজনক ‘সমকামী এজেন্ডা’, বাস্তবায়নের মূল বক্তব্যগুলোকে শিশুদের পাঠ্যবইয়ে ঢুকানো হয়েছে।

আবার পাঠ্যক্রমের রূপরেখায় খোদ পশ্চিমে বিতর্কিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল ‘জেন্ডার রূপান্তর’ ধারণাকে প্রবেশ করানো হয়েছে। একইসাথে হাজার বছর ধরে চলে আসা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পারিবারিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখা পারিবারিক অনুশাসনকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। শিশুসন্তানদের পরিবারের একটি শিক্ষা কাঠামোতে বেড়ে ওঠা এবং পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে ছোটদের আদব কায়দা বা পারিবারিক শিষ্টাচারের পরিবর্তে সন্তানদের যৌথ বন্ধন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একা করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আবার সন্তানদের নিকট পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ বা মুরব্বিদের মূর্খ বা সেকেলে হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক লাজ লজ্জা ও সঙ্কোচ ভেঙে দিয়ে পশ্চিমের আদলে ফ্রিমিক্সিং, ফ্রি সেক্স, বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড কালচার, বাল্যপ্রেমকে উসকে দেয়া হচ্ছে। ক্লাসরুম কিংবা ক্লাসরুমের বাইরেও ছেলেমেয়েদের খোলামেলা বা অবাধ মেলামেশায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতির নামে ‘হিন্দুবাঙ্গালী’র সংস্কৃতিকে মেজরিটি ‘মুসলিম-বাঙ্গালী’র ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের বীরত্বগাথা ইতিহাস স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়েও শিশুদের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জন্ম দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ছোট করে বারবারই বাংলাদেশকে ভারতে অংশ, বড় বাংলার অংশ বলে শিশুদের মনে ধারণা প্রোথিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় এই ধরনের অধ্যায় বা শিক্ষা চালু থাকলে আমাদের শিশুরা একটি সময়ে নিজেদের মনে প্রাণে ভারতের অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে নিজেদের ভাবতে শুরু করতে পারে। বর্তমান সরকার যেখানে ভবিষ্যতে ডিজিটাল ও পেপারলেস বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে সেখানে নতুন কারিকুলামে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের জ্ঞানকে কমাতে কমাতে একেবারে ২ শতাংশেরর নিচে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। এর পরিবর্তে সেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প সংস্কৃতি ইত্যাদি এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানের এই কারিকুলাম দিয়ে সরকারের ভিশন ২০৪১ পূরণ করার জন্য যোগ্য নাগরিক গড়ে উঠবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মো: বরকত আলী নয়া দিগন্তকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এক সময়ে আমরা পারিবারিক একটি শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই বড় হয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের সন্তানদের এমন এক শিক্ষাব্যবস্থায় বড় করে তুলছি সেখানে আগের পারিবারিক বন্ধনটি আর নেই। আমাদের ছোটবেলায় আমরা দেখেছি পারিবারিক অনুশাসন ছিল আমাদের সমাজের ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। কিন্তু একটি চক্র আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংস করার হীন অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার মাধ্যমেই বিগড়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এখন পারিবারিক শাসনকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা অবশ্যই ভালো কোনো লক্ষণ নয়।

বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সাবেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক এ বি এম ফজলুর করীম বলেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও নানা ধরনের অধ্যায় যুক্ত করে যেভাবে পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে তাতে আমাদের সন্তানদের সুনাগরিক হয়ে উঠার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আগে পড়েছি কবি ফররুখের কবিতা, সুফিয়া কামালের কবিতা, বিখ্যাত সেই ‘মা’ কবিতাসহ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য গদ্য এবং পদ্য। এসব লেখা পড়ে আমাদের সন্তানদের মনে দেশপ্রেম ও আল্লাহভীতি জাগ্রত হতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখন সেই লেখা গদ্য বা পদ্য আর পাঠ্যবইয়ে স্থান পায় না। এটা আমাদের জন্য কোনো মতেই সুখকর নয়। এটার অবসান হওয়া দরকার। তার জন্য পাঠ্যবইয়ে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে আমাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে সুনাগরিক হয়ে দেশসেবায় এগিয়ে আসতে পারে।

আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই ইসলামবহির্ভূত বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সময় চেয়েছি। সাক্ষাতে গিয়ে আমরা সাফ জানিয়ে দেবো এসব বিতর্কিত বিষয় ও ইসলাম সমর্থনযোগ্য নয় এমন বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বরাবরও আবেদন করে দেখা করে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের দাবি জানাব। ইসলাম ধর্মের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে থাকবে এটা কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না।

তিনি আরো বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে ইসলামবহির্ভূত কিছু বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতে আমাদের সন্তানরা ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে চলে যাবে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা করে কিন্তু এখানে দেখতে হবে কোন ধর্মের শিক্ষার্থীর হার বেশি এবং সেই অনুযায়ীই পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/840362