৩ জুন ২০২৪, সোমবার, ৬:৩৮

চাল চিনি তেল গরুর মাংসের দাম দেশেই সবচেয়ে বেশি

দেশে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চাল, চিনি, সয়াবিন তেল ও গরুর মাংসের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশেই অনেক বেশি। অবস্থা এমন, নিত্যপণ্য এখন বিলাসী পণ্যে পরিণত হয়েছে। গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলনে এই চিত্র তুলে ধরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

প্রতিষ্ঠানের ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৩-২৪: তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে পর্যালোচনা তথ্য তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

২০১৯ সালের জানুয়ারির সঙ্গে ২০২৪ সালের মে মাসের তুলনা করে তৈরি একটি প্রতিবেদন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এই সময়ে মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ, পাইজামের ১৫ ও মোটা চালের ৩০ শতাংশ। এর মানে হলো, যেসব পণ্য গরিব ও মধ্যবিত্তরা ব্যবহার করে এবং বাজারে বেশি বিক্রি হয়, সেগুলোতে মুনাফাখোররা বেশি লাভ করছে। এমনকি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে দেশে এখন চালের দাম বেশি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লিখিত পাঁচ বছরে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৮৪ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়, একইভাবে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ৫৬ শতাংশ বেড়ে ১৬৩ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ১০৬ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০৬ টাকায়। অথচ বিশ্ববাজারে একই সময়ে সয়াবিন তেল বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১০৫ টাকায়। আমদানি খরচ ও শুল্ক বাদ দিলে দেশের বাজারে পণ্যটি তুলনামূলক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

এই সময়ে গরুর মাংসের দাম ৫৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি হয়েছে ৭৬৫ টাকা। একই সময় বিশ্ববাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬৬৩ টাকায়। দেশে পাঁচ বছরে চিনির দাম ১৫২ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি হয়েছে ১৩০ টাকা। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে একই সময় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয় ৩৯ টাকায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৯৬ টাকায়। অর্থাৎ, বিশ্ববাজারে গড়ে পণ্যটি বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৫০ টাকায়।

এ ছাড়া দেশের বাজারে গত পাঁচ বছরে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৯৫ শতাংশ। একই সময় আটার দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ৬০, গুঁড়া দুধ ৪৬-৮০, পেঁয়াজ ১৬৪, রসুন ৩১০, শুকনো মরিচ ১০৫, আদা ২০৫ এবং গুঁড়া হলুদ ৭০ শতাংশ।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক। অনেক দিন ধরে এটি ৯-১০ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় দুর্বলতা দেখা গেছে।’ মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ইতোমধ্যে দেশটি তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে।’

সিপিডির প্রতিবেদনে ১৭টি দেশের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি এবং খাবারের পেছনে মাথাপিছু খরচের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ওই সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু জিডিপি সবচেয়ে কম, ৭ হাজার ৮০৫ ডলার। অথচ খাবারের পেছনে ওই ১৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে মাথাপিছু খরচ সবচেয়ে বেশি, ৯২৪ ডলার। তালিকার অন্য ১৬টি দেশ হলো– ইরান, ভারত, লাওস, শ্রীলঙ্কা, উজবেকিস্তান, আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, তিউনিসিয়া, বলিভিয়া, মরক্কো, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, জর্ডান ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

সিপিডির পর্যালোচনায় বলা হয়, দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিক কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতিতে তৈরি হওয়া সংকট পরের বছর কিছুটা কমে এলেও এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। পাশাপাশি রয়েছে নীতির দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও প্রয়োজনীয় সংস্কারে ব্যর্থতা।

এতে আরও বলা হয়, চলতি বছরে এসব চ্যালেঞ্জ নতুন নয়, আগেও ছিল। এগুলো মোকাবিলা করতেই সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারে গেছে, ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই সংস্কার কর্মসূচি বড় ধরনের ফল দেবে– এখন পর্যন্ত তা দেখা যায়নি।

সিপিডি মনে করে, সরকারের সামনে এখন দুটি পথ রয়েছে– উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও সামগ্রিক স্থিতিশীলতা। তবে উচ্চ প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে এগোনো উচিত। কিন্তু অর্থনীতির সূচকগুলো ধরার ক্ষেত্রে সরকার এক ধরনের গতানুগতিক পথে রয়েছে। চলতি অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। কিন্তু এডিবি বলছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ১ শতাংশ, আইএমএফ ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাংক বলছে, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রবৃদ্ধি কম হবে বলে প্রাক্কলন করছে। দেখা দরকার, এই নিম্ন প্রবৃদ্ধি নিয়ে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা অর্জন হয় কিনা। সেটি না পারলে দু’দিক থেকেই ক্ষতি হবে।
বাজেটের প্রাক্কলনে সরকার গতানুগতিক ভুল পদ্ধতির ওপর রয়েছে উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘প্রথম ছয় মাসের হিসাব প্রাক্কলন করা হয়েছে। এখানে ছয় মাসের মূল সূচকগুলো নেওয়া হয়েছে এবং একই সঙ্গে যেগুলোর তথ্য-উপাত্ত নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে বাজেটে যে টার্গেট ধরা হয়েছিল, সেটি ধরে প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হয়েছে। এই পদ্ধতিকে আমরা ভুল (ভ্রমাত্মক) বলে মনে করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন বাড়াতে সিলেট ও দক্ষিণাঞ্চলের এক ফসিল জমিকে কমপক্ষে দুই ফসলি করা দরকার। প্রবাসী আয় বাড়াতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

https://samakal.com/bangladesh/article/240312