৩ জুন ২০২৪, সোমবার, ৬:৩৪

ঝড়-বন্যার শঙ্কা এ মাসেই

চলতি জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কতিপয় স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ মাসে দেশে ৪ থেকে ৬ দিন হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বজ্র-ঝড় বা কালবৈশাখী ঝড় সংঘটিত হতে পারে। এ মাসে দেশে এক থেকে ২টি বিচ্ছিন্নভাবে মৃদু (তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ (৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সে.) বয়ে যেতে পারে। গত দুই মাসের মতো এ মাসেও দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে। চলতি জুন মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস প্রদানের জন্য গতকাল রোববার আবহাওয়া বিভাগের (বিএমডি) ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় এই পূর্বাভাস দেয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া বিভাগের পরিচালক ও কমিটির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান।

দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে আরো জানা গেছে, এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে ২টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং এর মধ্য থেকে একটি মৌসুমী নি¤œচাপে পরিণত হতে পারে। মৌসুমী নিম্নচাপের কারণে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এ মাসের চলতি প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বর্ষার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষাকাল) সারা দেশে বিস্তার লাভ করতে পারে। জুন মাসে সার্বিকভাবে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞ কমিটির উক্ত সভায় পর্যালোচনায় জানা গেছে, গেল মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) সারা দেশে মৌসুমের এ সময়ের স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ (৯ দশমিক ৭) বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে গত এপ্রিল মাসে গড়ে ৮১ শতাংশই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। মার্চ ও এপ্রিল টানা দুই মাসে সারা দেশে রেকর্ড উচ্চ তাপদাহ, খরা-অনাবৃষ্টি বিরাজ করে।

গত মে মাসে দেশে অঞ্চলওয়ারি বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতি বা গড়মিল রয়েছে। মে মাসে বরিশাল বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৯ শতাংশ বেশি, সিলেট বিভাগে ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি, খুলনা বিভাগে ৩৩.৪ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে রংপুর বিভাগে ৩৭.৫ শতাংশ কম, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৫.৯ শতাংশ কম, রাজশাহী বিভাগে ১৫.৯ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঢাকা বিভাগে ৮.৬ শতাংশ বেশি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২২.৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি ঝরেছে।

পর্যালোচনায় আরো জানা গেছে, গেল মে মাসে মার্চে দেশে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় যথাক্রমে গড়ে ১ দশমিক ৬ এবং ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। সারা দেশে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সে. বেশি ছিল। মে মাসে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৮ (১ মে)।

উত্তরাঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি : উজানে বন্যা : প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র সক্রিয় প্রভাবে এবং বর্ষাও মৌসুমী বায়ুর আগেভাগেই আগমনের কারণে উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে টানা অতি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সিকিম, অরুণাচল, মেঘালয় ও আসাম প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় দেশটির জেলার পর জেলা ডুবে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢল-বন্যায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গেও মাঝারি থেকে ভারী ও অতি ভারী বর্ষণ হচ্ছে। ভারতের বন্যার সাথে উজানের অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, বরাকসহ প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পাশাপাশি ভাটিতে অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়ছে ধীরে ধীরে। তিস্তা নদীর পানিও বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। বর্ষার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু আরো সক্রিয় হলে দেশের অভ্যন্তরেও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তখন নদ-নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল রোববার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গতকাল বিকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় তিনটি পয়েন্টেই পানি ১৯ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অন্যদিকে যমুনা নদের পানি দশটি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় সবক’টিতেই পানি ২৪ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার পরিমাণে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তিস্তা নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

যদিও এখন পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বিপদসীমার যথেষ্ট নিচে অবস্থান করছে।
গতকাল পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নদ-নদীর প্রবাহ ও পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। দেশের ১১০টি নদ-নদীর পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পায়, ৪৭টিতে হ্রাস পায়। ৪টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত থাকে। সিলেট অঞ্চলে দু’টি স্থানে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। আগের দিন শনিবার ১১০টি নদ-নদীর পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৪১টিতে বৃদ্ধি ও ৬৭টিতে হ্রাস পায়।

গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক জায়গায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, অতি ভারী বর্ষণও হয়েছে। এর মধ্যে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ১৯৪ মিলিমিটার, আসামের তেজপুরে ৭১ মি.মি., পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে ৬৩ মি.মি., জলপাইগুড়িতে ৫৬ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে। উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ঢল-বানের মাধ্যমে ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে পানি গড়াচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে নদ-নদীর পানি।

এদিকে গতকাল আবহাওয়া বিভাগ জানায়, বর্ষার ধারক-বাহক দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর এবং রাজশাহী বিভাগ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু আরো অগ্রসর হওয়ার জন্য আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে।

তাপদাহ হ্রাস ও বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির সম্ভাবনা : গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় টেকনাফে ১৪ মি.মি. বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত ছাড়া দেশের আর কোথাও কোন বর্ষণ হয়নি। গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলায় মৃদু তাপদাহ বয়ে যায়। আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, আজ সোমবার থেকে দেশের অনেক জায়গায় তাপদাহ ক্রমেই হ্রাস এবং বৃষ্টিপাত ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬.৫ এবং সর্বনিম্ন ২৮.১ ডিগ্রি সে.। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ডিমলায় ২৪.৫ ডিগ্রি সে.।

আজ সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়; ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।

ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বাগেরহাট, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলাসমূহের উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ কিছু কিছু জায়গা থেকে কমে আসতে পারে।

সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আগামীকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় এবং খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা এক থেকে ২ ডিগ্রি সে. হ্রাস পেতে পারে।

আগামী বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। এর পরের ৫ দিনে আবহাওয়ার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।

এদিকে আবহাওয়া বিভাগ জানায়, লঘুুচাপের একটি বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হয়ে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/662531