৩ জুন ২০২৪, সোমবার, ৬:২৩

বায়রা নেতাদের দাবি

বিমান টিকিট সিন্ডিকেট চক্রের কারণেই মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি বহু শ্রমিক

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়া এবং ৩১ হাজার কর্মীর নির্ধারিত সময়ে দেশটিতে যেতে না পারা নিয়ে চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। কাদের গাফিলতিতে শ্রমিকদের কপাল পুড়ল এ নিয়ে একপক্ষ অপরপক্ষকে দোষারোপ করার চেষ্টা করছেন।

তবে জনশক্তি ব্যবসার সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত প্রবীণ এবং তরুণ মালিকরা অনেকটা জোর দিয়েই বলছেন, শেষ সময়ে আকাশ পরিবহনে ব্যাপক অরাজকতা তৈরি হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া সরকারের দেয়া ৩১ মে এর ডেডলাইনের মধ্য হাজার হাজার শ্রমিক উড়োজাহাজে উঠতে পারেনি।

যদিও ব্যবসায়ীদের এমন দাবি মানতে নারাজ বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মালয়েশিয়াতে যেতে না পারা বাংলাদেশী শ্রমিকদের অনেকে ঢাকায় অবস্থান করে কিভাবে জমা দেয়া টাকাগুলো উদ্ধার করা যায়, সেটি নিয়ে দেনদরবার করার চেষ্টা করছেন। কারণ এসব শ্রমিকদের অনেকে সর্বস্ব খুইয়ে টাকাগুলো এজেন্সির মালিক, দালাল ও মালিকের প্রতিনিধির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাদের স্বপ্ন চাপা পড়েছে।

আটকেপড়া শ্রমিকদের আশঙ্কা, তারা মূলত সরকার নির্ধারিত ৭৯ হাজার ৮০০ টাকার মানি রিসিট পেলেও নগদ টাকা দিয়েছেন আরো সোয়া ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। যদি এখন পাওনা টাকা উদ্ধারে শ্রমিকরা মন্ত্রণালয় বা বিএমইটিতে অভিযোগ দিলেও সেক্ষেত্রে বিএমইটি কর্তৃপক্ষ শুধু ৭৯ হাজার টাকার সালিস করতে পারবেন। এসব নিয়ে শ্রমিকরা দালালদের সাথে দেন দরবার শুরু করেছেন বলে প্রতারিত শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।

এ দিকে ভিসাসহ যাবতীয় ডকুমেন্টস রেডি হওয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে ৩১ হাজারেরও বেশি শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যেতে পারেননি। তবে এমন তথ্যর সাথে ভিন্নতা পোষণ করছেন ব্যবসায়ীরা।

গতকাল রোববার জনশক্তি ব্যবসায়ীদের একমাত্র সংগঠন বায়রার মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী ৩১ মে, ২০২৪ তারিখের নির্ধারিত সময়ের মধ্য বিমান টিকিটের অভাবে মালয়েশিয়া যেতে না পারা ই ভিসা প্রাপ্ত কর্মীদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি লিখিত চিঠি দিয়েছেন।

ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, মালয়েশিয়া সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ই-ভিসার আওতায় কর্মীদেরকে ৩১ মে ২০২৪ তারিখের মধ্যে সেদেশে পৌঁছানোর সময়সীমা নির্ধারণ করে। একই সাথে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ২৮ মে ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত ই-ভিসা ইস্যু করে (কপি সংযুক্ত)। এর ফলে ৩১ মে ২০২৪ তারিখের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্য মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা সম্ভব হয়নি।

বায়রা মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী আরো বলেন, ই-ভিসা প্রাপ্ত কর্মীদের মধ্যে অনেকের জন্য বিএমইটির ছাড়পত্র গ্রহন করা হয় এবং বিমান টিকিটের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়। উল্লেখ্য, ৩১ মে তারিখে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ১টি, এয়ার এশিয়ার একটি এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১টি ফ্লাইট পরিচালনার সম্ভাবনা থাকায় মোট ৫৭২ জন কর্মী পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে এয়ারপোর্টে গমন করেন। এ বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ১০০ (বিআরএ) রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্য ৭০টি বিআরএর মাধ্যমে প্রসেস করা কর্মীদের তথ্য চিঠিতে তুলে ধরা হয়।

বলা হয়, ই-ভিসা পাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৫৯৫৩ জন। এরমধ্য ই-ভিসা এবং বিএমইটির ছাড়পত্র পাওয়া কর্মীর সংখ্যা হচ্ছে ৩৭০০ জন। বিএমইটির ছাড়পত্র প্রাপ্তদের মধ্য ৩১ মে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনালে উপস্থিত ছিলেন ৫৮২ জন।
এ ছাড়া অবশিষ্ট ৩০টি রিক্রুটিং এজেন্সির (বিআরএর) মাধ্যমে প্রসেস করা কর্মীদের মধ্যে কমবেশি ১০০০ জনের মতো কর্মী ই ভিসা অথবা বিএমইটির ছাড়পত্র প্রাপ্তির পর বিমান টিকিট প্রাপ্তি সাপেক্ষে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন বলে সচিবের কাছে দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি দেয়ার সত্যতা জানতে গতকাল বায়রা মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরীর বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

গতকাল সকালে কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সিনিয়র নেতা আলহাজ কাজী মফিজুর রহমানের সাথে মালয়েশিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে ৩১ হাজার শ্রমিক ডেডলাইনের মধ্য মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি। এই তথ্যটা মোটেও সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে কতজন যেতে পারেনি তার সঠিক তথ্য ১০০ এজোন্সর সাথে কথা বলে বের করার চেষ্টা করছি আমরা। তিনি বলেন, আমার জানা মতে ৩১ হাজার কর্মীর মধ্য অনেকের ভিসাও আসেনি। আবার কারো এখন পর্যন্ত এলোকেশনও হয়নি। আবার অনেক এজেন্সি লোক পাঠানোর পর জটিলতা দেখা দেয়ায় পরবর্তীতে সেগুলো আর প্রসেস করা হয়নি। যাদের ভিসা হয়নি তারা কি ৫ লাখ টাকা এজেন্সিতে জমা দিয়েছে? এমন প্রশ্ন রেখে কাজী মফিজ জানতে চান, মালয়েশিয়া সরকার ২৮ মে তারিখেও ই ভিসা ইস্যু করেছে। তাহলে ২-৩ দিনের মধ্যে কিভাবে আমরা ওই কর্মীদের পাঠাবো? এরপর ৩০ হাজার টাকার টিকিট সোয়া লাখেও মিলেনি? এসব পরিস্থিতির কারণে কিছু শ্রমিক যেতে পারেনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা যেতে পারেনি তাদের জন্য অবশ্যই আমি /আমরা ব্যথিত।

এর আগে কুয়ালালামপুরে অবস্থান করা বায়রার এখনো নির্বাচিত মহাসচিব দাবিদার শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে কত সংখ্যক শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেনি সেব্যাপারে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর কাছে জানতে চাইলে ১ ঘণ্টার মধ্য এটি জানা সম্ভব বলে আমি মনে করি। তবে শেষ সময়ে বিমানের টিকিটগুলো সিন্ডিকেটে ৬-৭টি চিহ্নিত এজেন্সির মাধ্যমে বিক্রি হওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ে মালয়েশিয়াগামীদের ওপর।

মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের নেতা ওয়াহিদুর রহমান নয়া দিগন্তকে ক্ষোভ জানিয়ে বলছেন, মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠানোসহ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে দোষ আছে এটার জন্য যে শাস্তি হওয়ার সেটা হবে। কিন্তু শেষ সময়ে কি কারণে দেশী বিদেশীএয়ারলাইন্সগুলো ৩০ হাজার টাকার টিকিট ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করল তার বিচার আগে করতে হবে। আর এই কারসাজির ঘটনার সাথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন পরিচালক জড়িত আছেন। তিনি আগে মালয়েশিয়াতে কান্ট্রি ম্যানেজার ছিলেন। তখনো তার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে টিকিট বিক্রির অভিযোগ ছিল। এ ছাড়া আরো কয়েকটি এয়ারলাইন্সের ঢাকার জিএসএ টিকিট সিন্ডিকেটে জড়িত। তাদের কারণে শ্রমিকা বিমানবন্দরে গিয়েও ফ্লাইট ধরতে পারেননি। মালয়েশিয়ায় পৌঁছার পরও এখনো কতজন শ্রমিককে নিয়োগকর্তারা বিমানবন্দর থেকে নিতে আসেননি এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদুর রহমান ও বায়রা মহাসচিব দাবিদার নোমান বলেন, যাদেরকে নিয়োগকর্তারা নিতে আসবেন না তাদের হতে পারে ফেরত দিতে পারেন। তবে এই সংখ্যাটা কত হবে তা বলা সম্ভব নয় বলে জানান তারা।

গতকাল এশিয়া কন্টিনেন্টাল (গ্রুপ) বিডির স্বত্বাধিকারী লোকমান শাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ায় যেসব শ্রমিক সময়মতো যেতে পারেনি এর জন্য আমাদের আকাশ ব্যবস্থার সাথে যারা সম্পৃত্ত তারাই বেশি দায়ী। এখন এসব শ্রমিককে কিভাবে দ্রুত পাঠানো যায় আমি সরকারের কাছে সেই দাবি জানাচ্ছি।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের অগ্রগতি পরিদর্শনে গিয়ে মালয়েশিয়ার বিমান টিকিট সঙ্কট নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছিলেন বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান। তিনি বলেন, বিমান ভাড়ার বিষয়টা সাপ্লাইয়ার এবং বিমানের ব্যাপার। যারা এটার সাথে জড়িত তারা ডেডলাইনের এক মাস আগে জানতো।

উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া সরকার গত মার্চ মাসে এক ঘোষণায় জানিয়েছিল, ৩১ মে এরপর বাংলাদেশসহ ১৪ সোর্সকান্ট্রিভুক্ত দেশ থেকে কোনো শ্রমিককে ঢুকতে দেবে না। এ নিয়ে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে লিড নিউজ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন বিষয়টি কর্তৃপক্ষ আমলে নিলে আটকেপড়া শ্রমিকদের যেতে সমস্যায় পড়তে হতো না। বরং ওই সময় মালয়েশিয়ার বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান প্রতিবেদনটিকে ‘গুজবে’ বলার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর ৩১ মে যা হবার তাই হয়েছে। যেটি এখন সবাই দেখছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকান্ড নিয়ে গত শনিবার বায়রা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্য আলোচনা হয়। সেখানে উপস্থিত একজন সাবেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূত হাইকমিশনের কর্মকান্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, একটা দেশকে রিপ্রেজেন্ট করেন হাইকমিশনার। তাদের আরো তৎপর হওয়া উচিত। এতে সরকারের ভাবমূর্তি আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করেন। অপর দিকে মন্ত্রণালয় ও বিএমইটিতে হয়রানি প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়।

প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : বিএমইটির ছাড়পত্র পেয়েও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি ১৬ হাজার ৯৭০ জন বাংলাদেশী কর্মী।

গতকাল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী এ তথ্য জানান।

এত বিপুলসংখ্যক কর্মীর যেতে না পারার কারণ খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয় ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, কেন তারা যেতে পারেননি এ ব্যাপারে আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটিতে ছয়জন সদস্য আছেন। অতিরিক্ত সচিব (মন্ত্রণালয়ের) নূর মোহাম্মদ মাহবুবকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি তাদের সুপারিশ দেবে। যারা এটার জন্য দায়ী হবেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবো। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা কর্মীরা তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন এবং প্রয়োজন হলে কর্মীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা হবে।

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বারবার সিন্ডিকেট বা চক্রের কারণে বন্ধ হচ্ছে। সিন্ডিকেটে সরকারের প্রভাবশালী সংসদ সদস্যদের নামও এসেছে গণমাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে বা যারা এ তদন্তের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন বলেন, ২৪ মের পর থেকে যাদের টিকিট ছিল শুধু তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কাউকে অনুমোদন দেয়া হয়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/839874