৩ জুন ২০২৪, সোমবার, ৬:১৮

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে-১৪

গল্প আর তত্ত্বের বেড়াজালে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানবিমুখ

নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে এমন সব গল্প দেয়া হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক না করে বরং তাদেরকে করছে বিজ্ঞানবিমুখ। ২০২৪ সালের ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান অনুসন্ধান বইয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধ্যায়ে ৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হাজার হাজার বছর থেকে বিজ্ঞানের নানা তত্ত্বকে প্রতিনিয়ত যাচাই করে আসা হচ্ছে বলে বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর কোনটা কতটুকু সত্যি সেটা আমরা জানি। যখন প্রয়োজন হয় তখন বিজ্ঞানের তত্ত্বকে আমরা পরিবর্তন করি কিংবা পরিমার্জন করি। সেজন্য বিজ্ঞানের ওপর আমরা সবসময় নির্ভর করতে পারি।

এই আলোচনায় বেশ কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহ ও সংশয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন আধুনিক বিজ্ঞানের বয়সই মোটা দাগে তিনশত বছর যেখানে হাজার হাজার বছরের তত্ত্ব যাচাই করাতো কাল্পনিক আজগুবি কথা মাত্র। কাজেই এভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বিজ্ঞানের বইকে গল্পের বই বানালে আমাদের শিক্ষার্থীরা আসলে কী শিখবে?

এখানে প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, বিজ্ঞানের মূল কথাই হলো বিজ্ঞানের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা যাচাই বাছাই করে জ্ঞান উৎপাদন করা । বিজ্ঞান হচ্ছে চিন্তার একটি পদ্ধতি যেখানে আমরা বিভিন্ন জাগতিক ঘটনাবলি নিয়ে প্রশ্ন করি এবং সেই প্রশ্নের জাগতিক ব্যাখ্যাটাকেও যাচাই বাছাই করে দেখি সেটি কার্যকর কি না? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর তত্ত্ব নিয়েও প্রাজ্ঞ গবেষকরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, সেটা কতটুকু কাজ করে সেটাও তারা যাচাই বাছাই করে দেখতে পারেন। তাই দেখা যায় সব তত্ত্ব নিয়েই নানাবিধ অভিযোগ বা প্রশ্ন উঠতেই পারে। জগতের তথ্য উপাত্তের সাপেক্ষে বিজ্ঞানের নানা তত্ত্বকে প্রতিনিয়ত যাচাই করা উচিত। যখন পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত ও বিশ্লেষণ একাট্টা করে শক্ত সামাজিক অবস্থান তৈরি হয় তখন তত্ত্বকে পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জন করা সম্ভব হতে পারে। তাই বিজ্ঞানকে গ্রহণের ক্ষেত্রে সবসময়ই সচেতন থাকা জরুরি।

তথ্যসূত্র : Thomas Kuhn, The Stucture of Scientific Revolutions (University of Chicago Press,1996)
অপর এক জায়গায় বলা হয়েছে বিজ্ঞান এক ধরনের জ্ঞান যেটি যুক্তিতর্ক পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে যাচাই করতে পারি, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, সব ধরনের জ্ঞানই কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্র নয়। আমাদের চারপাশে যে বাস্তব জগৎ আছে সেটি হচ্ছে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র। তাই ভালোবাসা হিংসা বা নৈতিকতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে যে জ্ঞানটুকু গড়ে উঠছে সেটি বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। অর্থাৎ প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ঘটনা হচ্ছে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র।

পাঠ্যপুস্তকের এই আলোচনাটিও ভুল। কেননা বিজ্ঞান এক ধরনের জ্ঞান যা যুক্তিতর্ক, পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে যাচাই করতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, সব ধরনের জ্ঞানই কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্র নয়। বিজ্ঞান কিছু পূর্বানুুুমান, গণিত যুক্তি, ইতিহাস দর্শন নৈতিকতা বা ভালোবাসার মতো বিষয়গুলো নিয়ে যে জ্ঞান গড়ে উঠেছে তা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। অর্থাৎ কেবল প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলি হচ্ছে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র। স্রষ্টা আছে কি না বা অলৌলিক ঘটনা ঘটতে পারে কি না এসব বিষয়ে বিজ্ঞান কোনো মন্তব্য করতে পারে না। তথ্যসূত্র: Science has limits: A few things that science does not do. Understanding Science 101, University of California, Berkeley.

ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে পৃষ্ঠা ৩ এবং ৪ এ দুইজন বিজ্ঞানী অধ্যায়ে এমন একটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেখানে বিষয়টি বিতর্কিত ও যথেষ্ট সন্দেহ সংশয় রয়েছে। এই অধ্যায়ে দু’জন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । হরিপদ কাপালীকে বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা পদ্ধতিগত ভুল। কেননা তার কোনো প্রস্তাবিত অনুকল্প নেই, তাত্ত্বিক কাঠামোও নেই, এমনকি নেই কোনো পদ্ধতিগত গবেষণাও। কেন ফলন বেশি তার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও তিনি হাজির করতে পারেননি। সেই ধানের জিনোম অধ্যয়ন তার সাধ্যের এমনকি চিন্তারও বাইরে। মানুষ তার অস্তিত্বের শুরু থেকে অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অন্যের সাথে বিনিময় করেছে। যে মানুষ প্রথম আগুন আবিষ্কার করলেন তাকে তো বিজ্ঞানী বলা হয় না বা তার নামে আগুনকে নাম দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে সঠিকতর পদক্ষেপ হবে হরিপদকে বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় না করিয়ে প্রথম বিজ্ঞানীর ব্যাপারে তথ্য ছাত্রছাত্রীদের জানানো। পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হতো যেমন, বিজ্ঞান আসলে শুধু বড় বড় ল্যাবরেটরি এবং দক্ষ অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের জন্য নয়। একজন সাধারণ মানুষের যদি অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি থাকে তাহলে তিনিও বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারেন। এমনই একজন হলেন হরিপদ কাপালী। বিষয়টি আরো খোলামেলাভাবে এভাবে বলা যেত হরিপদ কাপালী একজন কৃষক হলেও তিনি আসলে অনুসন্ধানী।
পাঠ্যপুস্তকে ৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞান যেহেতু একটি জ্ঞান এবং চিন্তার একটি প্রক্রিয়া তাই বিজ্ঞানের মধ্যে খারাপ কিছু থাকার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সেই জ্ঞানটুকু ব্যবহার করে যখনই কোনো একটি প্রযুক্তি গড়ে তোলা হয় সেটি কিন্তু যে রকম ভালো হতে, পারে ঠিক সেই রকম খারাপও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নিউক্লিয়ার বোমা। ঠিক সে রকম জৈব রসায়নের জ্ঞান ব্যবহার করে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য ওষুধ তৈরি করা হয়। একইভাবে আবার এই জ্ঞান ব্যবহার করে ভয়াবহ মাদক তৈরি করা হয়।

এই অধ্যায়ের প্রথম দু’টি লাইন অনেকটা আবেগী বক্তব্য। কেননা বিজ্ঞানের মধ্যে খারাপ কিছু থাকতে না পারলে ভালো কিছুও থাকার কথা নয়। চিন্তার প্রক্রিয়া ভালো/ মন্দ না, সঠিক/ ভুল হয় মাত্র। এখানে উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞান যেহেতু একটি জ্ঞানার্জন ও চিন্তার প্রক্রিয়া তাই এর দ্বারা কল্যাণ হবে নাকি অকল্যাণ হবে সেটা মানুষের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বিজ্ঞানের জ্ঞানটুকু ব্যবহার করে যখনই কোনো একটি প্রযুক্তি গড়ে তোলা হয়।

অপরদিকে বিজ্ঞানের জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার সময়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে পক্ষপাতদুষ্ট জ্ঞান তৈরি সম্ভব। প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণকে সামনে রেখে তৈরি হতে পারে কিন্তু সেটি ভালো হওয়ার পাশাপাশি খারাপও হতে পারে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/839877