৩ জুন ২০২৪, সোমবার, ৬:১৫

ঋণ নির্ভরশীলতা বাড়ায় বিপজ্জনক পথে দেশ

দেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা। এমন মন্তব্য সাবেক মন্ত্রী, সাবেক অর্থনীতির শিক্ষক ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। গতকাল রোববার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে ঋণগ্রস্থ করে ফেলেছে। সরকার ঋণ নিয়ে নিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে পুরোপুরি ঋণগ্রস্থ করে ফেলেছে। সর্বত্র ত্রাহি অবস্থা করে দিয়েছে। এমন অবস্থা হচ্ছে যে, ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই সরকার কত দায়িত্বহীনতা চিন্তা করেন, একটা ভবিষ্যত প্রজন্মকে ঋণের ওপর রেখে যাচ্ছে। রুপপুরসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পগুলোও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে করে দেশকে ঋণনির্ভর করে ফেলেছে। এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে করতে আমরা শেষ হয়ে যাবো।

সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এক অনুষ্ঠানে বলেছে, গত তিন বছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৫০ হাজার টাকা বেড়েছে। তিন বছর আগে মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকার উপরে। ফলে বাংলাদেশ বিপজ্জনক পথে আছে। সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, আশির দশকে অনেক আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান দেশ স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছিল। সম্প্রতি এর বড় উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশেও স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাড়ছে, শ্রীলঙ্কার মতোই বিপজ্জনক পথে আছে এ দেশ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমাদের বিদেশি ঋণ ছিল সহনীয় পর্যায়ে। আমরা এখন যদি সতর্ক না হই, তাহলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। তিনি বলেন, বিদেশি ঋণ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না, ১৯৮০ সালের দিকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো বিদেশি ঋণ নিয়ে এ ধরনের বড় সমস্যায় পড়েছিল। সাম্প্রতিক ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়া গ্রিস বড় উদাহরণ। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও ঘানার মতো দেশের উদাহরণ তো আছেই। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণ বহনের সক্ষমতা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা উদ্বেগ তৈরি করেছে। দিন শেষে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উভয় ঋণ পরিশোধের জন্য বিবেচনা করতে হবে। এক গবেষণা জাতিসংঘের গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ বলেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের তুলনায় অনেক দ্রুত ও বেশি বিদেশি ঋণ নিয়েছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই এ কারণে তা উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ঋণের চাপে অনেকে আছে, অনেকে খেলাপি হয়েছে। উন্নয়নশীল এসব দেশের সরকারি ঋণ ২০১০ সালে জিডিপির তুলনায় ৩৫ শতাংশ ছিল, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে। এর মধ্যে একই সময় দেশগুলোর বিদেশি ঋণ ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। এসব বিদেশি ঋণের মধ্যে ব্যক্তি খাতের ঋণও একইভাবে বেড়েছে। একই সময় ব্যক্তি খাতের ঋণ ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে।

সিপিডি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বেড়েছে।
২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮.৯ বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা দ্রুত বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটি।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বড় আকারের অনেক প্রকল্পই অতিমূল্যায়িত করে খরচ বাড়ানো হয়েছে। আবার প্রকল্পের ভেতরে বাস্তবায়ন পর্যায়ে কোনো না কোনো স্বার্থগোষ্ঠীকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে জনগণের প্রাথমিক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গড়ে উঠলেও বাংলাদেশে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে জনসাধারণের টাকা লুটের মাধ্যমে পুঁজি গড়ে উঠেছে। বিদেশি ঋণ নেওয়া প্রকল্পগুলোর মাধ্যমেও ব্যক্তি খাতে পুঁজি গড়ে উঠেছে। এটা বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতের জন্যই প্রযোজ্য। দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে সরকারের দায় বৃদ্ধির প্রবণতা তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারের মাথাপিছু বিদেশি ঋণ তিন হাজার ১০ ডলার। আর অভ্যন্তরীণ উৎসর ঋণ মিলে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়ায় আট হাজার ৫০ ডলারে। স্বাধীনতার এত বছর পরে সরকারের মাথাপিছু ঋণ এক লাখ টাকায় উঠেছিল অথচ তা পরের তিন বছরেই দেড়গুণ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি ঋণ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে দাবি করলেও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মোডি বা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস হিসেবে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমছে বলে দাবি করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে সরকারের হিসেবেই কমেছে। এ ছাড়া শিক্ষা, ট্রেনিং বা কর্মে নেই এমন মানুষের হার বেড়েছে, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিবারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে ঋণ করে চলে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে ঋণনির্ভরতা বাড়ছে। দেশে রিজার্ভের পরিমাণ যেভাবে কমে যাচ্ছে তা শঙ্কার কারণ হতে পারে। আর্থিক খাতে সুশাসনে অনেকটা এগিয়ে ছিল এক সময়, বর্তমানে কিভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে, সেটাই বিস্ময়কর। তিনি আরও বলেন, আইএমএফের পরামর্শ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে গ্রহণ করতে হবে।

সূত্র মতে, আগামী ৫ জুন বসছে বাজেট অধিবেশন। বরাবরের মত রাজস্ব প্রাপ্তির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা এবারও থাকছে, সঙ্গে যোগ হচ্ছে ব্যয় সংকোচন নীতি, যে কারণে এবার বাজেট ঘাটতি সামান্য কমে আসার আভাস মিলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যে। তবে তাদের সামনে বরাবরের মত এবারও ঘাটতি পূরণে বিকল্প কম, সেই ঋণ নির্ভরতাই প্রধান সমাধান। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম সুদের বিদেশি ঋণের পরিবর্তে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি সুদের ঋণের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সেভাবেই বাজেট ঘাটতি মেটানোর হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলতে থাকায় তা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ নেওয়ায় তারল্য সংকট পরিস্থিতিও দেখা দিয়েছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বারবার চাপের মুখে পড়ার কথা বলে আসছেন তারা। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, বাজেটে ঘাটতি বেশি হলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায়। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ঠিক রাখতে হলে অবধারিতভাবে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশকে কেউই সহজ ঋণ দিতে চাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ কম। প্রতিবছর এই ঘাটতি হওয়া মানেই হচ্ছে অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাওয়া। সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের সিংহভাগ খেয়ে ফেলবে। সুতরাং বাজেটে ভারসাম্য হওয়ার খুব দরকার ছিল।

জানা গেছে, ঋণের এমন প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০৫ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। চলতি বাজেটের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাড়িয়ে আগামী বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ধরার খবর এসেছে। এ ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেওয়ার চেষ্টার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের হিসাব নিকাশ করা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার (৫ লাখ কোটি টাকা) চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে মোট বাজেট ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে জোগান দেওয়া গেলেও ঘাটতির বাকি ৩২ শতাংশের যোগান দিতে নেওয়া হবে দেশি-বিদেশি ঋণ। ঘাটতি পূরণে চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও আগামী বাজেটে তা আরও বাড়িয়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এখানে অনুদান বাবদ ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেট হিসাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।

তবে আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধরা হলেও আগামী বাজেটে তা ধরা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এ পরিমাণ ঋণ পরিশোধের পর আসন্ন বাজেটে বিদেশি নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৯৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের নিট ঋণ এক লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার চেয়েও সাড়ে ৭ শতাংশ কম।

সূত্র মতে, ব্যয় বাড়লেও রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। ঘাটতি পূরণে দেশী-বিদেশী উৎসগুলো থেকে প্রতিনিয়ত ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। বাড়ছে সরকারের দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতিও। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে সরকারের নেয়া মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায়। অর্থ বিভাগের গত মাসে প্রকাশিত ডেবট বুলেটিনের এ হিসাব অনুযায়ী গত এক অর্থবছরে সরকারের ঋণের স্থিতি বেড়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা এ সময় সরকারের আহরিত মোট রাজস্বের প্রায় ৮৩ শতাংশের সমপরিমাণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। রাজস্ব ও ঋণের এ অসামঞ্জস্যতায় চাপ বাড়ছে সরকারের কোষাগারে। বাড়ছে ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধিত অর্থের পরিমাণও। গত অর্থবছরে সরকারকে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে এ বাবদ বরাদ্দের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকা। যদিও পরিশোধ করতে হয়েছে ৯২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য সরকারকে এখন নতুন করে আরো ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে সুদসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকির মাত্রাও এখন বাড়ছে। বাড়তি এ ঋণের মধ্যে বিদেশী ঋণের অবদানই সবচেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে দেশে স্থানীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৯৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। আর বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। বিদেশী ঋণে নির্ভরতা বাড়ায় শঙ্কিত হয়ে উঠছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারের সংকটজনিত কারণে এ ঝুঁকি আরো প্রকট হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো সহনীয় অবস্থানে থাকলেও এখানে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত সমজাতীয় অর্থনীতিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘গত অর্থবছরে ঋণের পরিমাণ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যদি আমরা বজায় রাখতে না পারি তাহলে এটি আমাদের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে যাবে। প্রতি বছর যদি আমাদের ঋণ বাড়তে থাকে তাহলে ঋণের চাপে আমাদের রাজস্ব হারিয়ে যাবে। যে পরিমাণ ঋণ বেড়েছে, সেটি আমাদের রাজস্ব আয়ের প্রায় সমপরিমাণ। এ বিষয়টি আমাদের ঝুঁকি কতটুকু সেটি নির্দেশ করে। আমাদের রাজস্ব অবিশ্বাস্য রকমের কম। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে আমাদের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৩৫০ থেকে ৪০০ শতাংশ হয়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে আমাদের ঋণ সাড়ে তিন থেকে চার বছরের রাজস্বের সমান, যা অনেক বেশি।

সরকারের সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো আশি-নব্বই দশকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এ দেশগুলোর সম্পদের পরিমাণ ছিল অনেক কম। তারা এত বেশি পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিয়েছিল যে এক পর্যায়ে গিয়ে ঋণ নিয়ে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশও এ ধরনের ঋণফাঁদে পড়তে যাচ্ছে।

সরকারের ঋণ স্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে ঋণ বেড়েছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এ সময়ে স্থানীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান গণমাধ্যমে বলেন, ঝুঁকি তো অবশ্যই আছে, ঝুঁকিবিহীন কোনো দেশ নেই পৃথিবীতে। তবে ঝুঁকি যদি হিসাব করে নেয়া হয়ে থাকে, তাহলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা আশা করি, সামনে শুধু ঋণ নয়, আয়ও বাড়বে।

https://dailysangram.info/post/557886