২ জুন ২০২৪, রবিবার, ১০:২২

মুসলিম বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানেই গলদ

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে-১৩

নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিল্প সংস্কৃতি বইয়ে বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানে যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেখানেই বড় ধরনের গলদ রয়েছে। বইয়ের বিষয় পরিচিতিতে বলা হয়েছে , বাংলাদেশে রয়েছে অনেক জাতিসত্তা আর সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের দেশের এই নানা জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষের রয়েছে নিজস্ব জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। হরেক রকমের সাংস্কৃতিক এই মেলবন্ধন আমাদের দেশকে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। আমাদের সংস্কৃতি হলো আমাদের শিকড়। শিকড়ের সাহায্যে গাছ যেমন পুষ্টি পায়, বেড়ে উঠে, তেমনি আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে মূল বা শিকড় হিসেবে গণ্য করে হয়ে উঠবো বিশ্বনাগরিক।

এখানে লক্ষণীয় যে, একবার বলা হচ্ছে নানা জাতির হরেক রকম সংস্কৃতি আছে, আরেকবার বলা হচ্ছে, আমাদের সংস্কৃতিকে শেকড় গণ্য করতে হবে। সংস্কৃতি যদি হরেক রকমই হয় তবে কোন সংস্কৃতিকে শেকড় হিসেবে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা গণ্য করবে? বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতিকে নাকি বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিকে? নাকি আবার চাকমা সংস্কৃতিকে? দুটো কথাই কিন্তু এখানে সাংঘর্ষিক।
একই বিষয়ের বইয়ের ভূমিকাতে আবার বলা হয়েছে, শিশুদের সৃজনশীল চিন্তার সঠিক বিকাশ ঘটানো যায় পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক জাতি স্বীয় শিল্প ও সংস্কৃতি নির্ভর শিক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেদের সৃজনশীলতা বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার মাধ্যমে। যে জাতি নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসে সে অন্যের সংস্কৃতিকে সম্মান করে। নিজস্ব জাতিসত্তাকে কিভাবে বিশ্বজনীন করে উপস্থাপন করা যায় তা জানতে হলেও একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাই শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে রস আচ্ছাদন করতে পারা। নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন-পালন করার মাধ্যমে অন্যের সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীল হতে পারা। নান্দনিক ও রুচিশীলভাবে জীবনযাপনে আগ্রহী হওয়া এবং নিজেদের সৃজনশীলতাকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা। সেটা কোন সংস্কৃতি? বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতি নাকি বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতি?

নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে আলোচনায় বলা হয়েছে আমাদের সমাজে বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন, ঘর-বাড়ি, আচার-আচরণ, ভাষা, খাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় উৎসব, রীতিনীতি, শিল্পকলা, চিত্রকলা, সঙ্গীত, নাট্য, আবৃত্তি, সাহিত্য ও ইত্যাদি সংস্কৃতির সন্নিবেশ । এসব সংস্কৃতিকে আবার বন্তুগত এবং অবস্তুগত সংস্কৃতি এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই বিষয় যদি সংস্কৃতির উপাদান হয়ে থাকে তাহলে এই অঞ্চলের ৯১ ভাগ মানুষের সংস্কৃতির প্রতিফলন আমাদের পাঠ্যবইয়ে হয়নি। কেননা, শূন্য থেকে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয় না। সংস্কৃতি সৃষ্টি হয় বিশ্বাস (ইবষরবভ ঝুংঃবস) থেকে। আমরা যা তা-ই আমাদের সংস্কৃতি- যদি হয়, তবে মানুষ তা-ই করে, যা সে বিশ্বাস করে। (ইবষরবভ ঝুংঃবস) যে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্মই হতে হবে, তা নয়। কেননা নিধর্মী কোনো বিশ্ববীক্ষাও কোনো জাতির বিশ্বাসের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেক্যুলারিজমও একটি (ইবষরবভ ঝুংঃবস)। সংস্কৃতির প্রতিটি উপাদানই একটি (ইবষরবভ ঝুংঃবস) কে ঘিরে নির্মিত। আরেকটি বিষয় যদি ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। যেমন, ধর্ম নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়। বিশ্বাসেই তার পরিসমাপ্তি, তা কিন্তু নয়। ধর্ম মানুষের কর্মকে প্রভাবিত করে। একদল মানুষের কর্মকে ধর্ম/ বিশ্বাস যেভাবে প্রভাবিত করে সেটা কিন্তু তার সংস্কৃতি। এখানে বিশ্বাস যদি সংস্কৃতির অংশই হয় তবে বাঙালি সংস্কৃতি বহু বছর আগেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, যেহেতু বিশ্বাস দুই রকম হয়ে গেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ভাষা ধর্ম ও বিশ্বাস রীতিনীতি সামাজিক মূল্যবোধ উৎসব জীবনবোধ দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনাচরণ, প্রতিটির সাথে ধর্মের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

হিন্দু বাঙালি এবং মুসলিম বাঙালিদের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের কিছু পার্থক্য:
সংস্কৃতির পার্থক্যের বিষয় হিন্দু বাঙালি মুসলমান বাঙালি ভাষা জয় শ্রীরাম, দুর্গা দুর্গা,
করবো, ভালো আছি, জল আল্লাহ হাফেজ, খোদা হাফেজ,ফি আমানিল্লাহ, করবো ইনশা আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, পানি ধর্ম ও বিশ্বাস সর্বেশ্বরবাদ একত্ববাদ, তাওহিদ রীতিনীতি পণপ্রথা, শবদাহ, মুখাগ্নি, বিবাহ লগ্ন, সাতপাক, সকালে আহ্নিক, উপবাসে ফলের রস চলবে মোহরানা, জানাজা, কাফন, দাফন, বিবাহ, ইজাব, কবুল, সাক্ষী, জন্মের পর আজান ইকামাত, ৫ ওয়াক্ত নামাজ, ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত একদম না খাওয়া, রোজা উৎসব দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, কালি পূজা, রোজার ঈদ, কোরবানির ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর জীবনবোধ পুনর্জন্মকে ঘিরে নির্মিত এক জীবন, একটাই চান্স পোশাক ধুতি, পৈতা লুঙ্গি, পায়জামা দৃষ্টিভঙ্গি জাত-পাত, অশুচির ধারণা এসব কিছুই নেই খাবার গরু খায় না গরু খায়, এবং হালাল হারাম মেনে চলা হয়। উপরের ছকটি লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে সংস্কৃতির প্রতিটি উপাদানে ধর্মের গভীর প্রভাব আছে। ধর্মকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতি কল্পনাই করা যাচ্ছে না। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার নাম দিয়ে যে শিক্ষা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তা ধর্ম থেকে নিরপেক্ষ নয়, বরং হিন্দুধর্ম (ইবষরবভ ঝুংঃবস) ঘিরে নির্মিত।

যদি ধর্মকে বাদ দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি খোঁজা হয় তবে আর্যরা আসার আগের সংস্কৃতি খুঁজতে হবে। মুসলমানরা বহিরাগত হলে বৈদিক ব্রাক্ষ্মণরাও বহিরাগত। আর্যরা আসার পর এখানকার স্থানীয় কালচারকে প্রভাবিত করেছে। মুসলমানদের আগমনে সেটা প্রভাবিত হয় এবং জাতিগত মিশ্রণ ঘটে। আরব, তুর্কি ইরানিদের সাথে এদেশীয় হিন্দু অহিন্দু অনার্য বৌদ্ধ অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটে। হিন্দু প্রভাবিত সংস্কৃতির নানান উপাদন পরিত্যক্ত হয় এই নতুন জাতির মধ্যে। তদস্থলে মুসলিম প্রভাবিত সাংস্কৃতিক উপাদান যুক্ত হয় গত ৭০০ বছরে। ফলে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির আত্মা (ইবষরবভ ঝুংঃবস) সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূর্ববঙ্গের বাঙালিত্ব আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিত্বের মূল সুরই ভিন্ন, যার ওপর সংস্কৃতি দাঁড়াবে। হিন্দু বাঙালির নৃতত্ত্বও ভিন্ন, যেহেতু মুসলিম বাঙালির মধ্যে আরব-তুর্কি ইরানিদের মিশ্রণ রয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিল্প সংস্কৃতির নামে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সংস্কৃতিকে পূর্ববঙ্গের উপর চাপানোটা সংখ্যাগুরুকে নির্যাতনের শামিল। সংখ্যাগুরু যদি নিজেকে বঞ্চিত, অপাঙ্ক্তেয়, নির্যাতিত অনুভব করে তার পরিণাম শুভ না হয়ে বরং হবে ভয়ঙ্কর।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/839547