১ জুন ২০২৪, শনিবার, ৪:৩৬

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস আজ

দুধ উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর ধারেকাছেও নেই বাংলাদেশ

গত এক দশকে দেশে দুধ উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কিন্তু দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসেনি এখনো। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিজনের দিনে ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম দুধ খাওয়া প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩৭ লাখ ধরে বছরে ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন দুধের প্রয়োজন। তবে উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার টন। প্রতিজনের দুধের প্রাপ্যতা প্রায় ২২২ গ্রাম। যদিও দুধের এই প্রাপ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলের। তারা বলছেন, প্রথমত. দেশের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান সঠিক নয় (বিবিএস হিসাবের বেশি আছে), আবার দুধ উৎপাদনের যে হিসাব দেয়া হচ্ছে তার বড় একটি অংশ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং দুধের প্রাপ্যতা অনেক কম। বিশেষ করে উচ্চ মূল্যের কারণে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশির ভাগ মানুষেরই দুধ এখন নাগালের বাইরে।

জানা যায়, দুধ উৎপাদনে বিশে^র যে কয়টি দেশ নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে তার ধারেকাছেও নেই বাংলাদেশ। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত পৃথিবীতে দুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থান (২০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩০ মেট্রিক টন) ধরে রেখেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আমেরিকা (১০ কোটি ২৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৬ টন)। আর পাকিস্তান তৃতীয় (৬ কোটি ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার টন) ও চীন চতুর্থ স্থান (৪ কোটি ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬৪ টন) ধরে রেখেছে। দুধ উৎপাদনে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে অন্য দেশগুলো হলো- ব্রাজিল, জার্মানি রাশিয়া, ফ্রান্স, তুর্কিয়ে ও নিউজিল্যান্ড। তালিকার ৩৮ নম্বরে বাংলাদেশের নাম রয়েছে। যদিও জনসংখ্যা ও দুধ উৎপাদন ও ব্যবহারের সঠিক হিসাব কষলে এ সংখ্যা আরো পিছিয়ে যাবে বলেই মনে করেন অনেকে।

এমন বাস্তবতায় ‘বৈশ্বিক পুষ্টিতে দুধ অপরিহার্য’ এমন প্রতিপাদ্যে আজ শনিবার সারা দেশে পালিত হচ্ছে বিশ^ দুগ্ধ দিবস। এ উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট (কেআইবি) মিলনায়তনে ৫০ জন ডেইরি উদ্যোক্তার মাঝে দেয়া হবে পুরস্কার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান এতে প্রধান অতিথি থাকবেন। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা সদরে জেলা প্রাণিসম্পদ দফতরের আয়োজনে দিবসটি পালিত হবে। আজ সকালে ৯টার মধ্যে রাজধানীর ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি বেসরকারি দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে দুধ পান করানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, প্রতিজনের দুধ প্রাপ্যতার পরিমাণ দৈনিক প্রায় ২২২ গ্রাম। অন্য দিকে বিবিএস থেকে প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২-এর তথ্যানুযায়ী, শহরে বসবাসকারী একজন মানুষের দৈনিক দৈনিক মাথাপিছু দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের হার ৩৮ দশমিক ৫ গ্রাম। গ্রামের মানুষের মধ্যে এ হার ৩২ দশমিক ১ গ্রাম। সার্বিকভাবে দেশবাসীর দুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে আদর্শ মানের চেয়ে ঘাটতি যথাক্রমে ৮৬ শতাংশ।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৬০ লাখ ৯২ হাজার টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৯ লাখ ৭০ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭২ হাজার ৭৫ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯২ লাখ ৮৩ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৪ লাখ ১ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৯ লাখ ২৩ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার টন দুধ উৎপাদন হয়েছে। দেশে মোট দুধের ৯০ শতাংশ আসে গরু থেকে, আট শতাংশ আসে ছাগল থেকে এবং দুই শতাংশ আসে মহিষ থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে একদিকে গ্রামের খামারিরা দুধের ন্যায্য মূল্য পান না। অন্য দিকে রাজধানী ঢাকাসহ শহরগুলোতে দুধের উচ্চ মূল্যের কারণে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মিল্কভিটাসহ অন্যান্য কোম্পানির এক লিটার তরল দুধ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর কৃষকের কাছ থেকে গাভীর খাঁটি দুধ পাওয়া তো আরো কঠিন। দাম আরো বেশি।

বিগত কয়েক বছর দেশে গোখাদ্যের দাম বহুগুণে বেড়ে গেছে। এ কারণে খামারিদের দুগ্ধ উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খামারিরা গাভী পালনে খরচই তুলতে পারছেন না।

এ ছাড়া কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, মানসম্পন্ন দুধ সরবরাহ না করা, ভেটেরিনারি চিকিৎসক সঙ্কট, দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করতে না পারা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং বিদ্যুতের মূল্য কৃষিভিত্তিক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি হওয়াও উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করেন খামারিরা।

বেশি দুধ ও গোশত উৎপাদনে ব্রাহমাসহ বিভিন্ন উন্নতজাত আনার দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের খামারিরা। খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মো: ইমরান হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের হিট টলারেন্ট উন্নত জাত দিক সরকার। তাহলে দেশ দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পণ হবে। গোশত উৎপাদনও বাড়বে। পাশাপাশি গোখাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা জানান খামারিদের এ শীর্ষ নেতা।

খামারিদের সাথে অনেকটা একমত প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (উৎপাদন) ডা: এ বি এম খালেদুজ্জামান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা হলেস্টিন ফ্রিজিয়ান জাতের বীজ দিয়ে আমাদের লোকাল জাতের ডেভেলপ করেছি। ক্রসব্রিড করেছি। এতে প্রতি গরুর দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। আজকে আমরা এই পর্যায়ে এসে বিশ্বের যেসব উন্নত জেনেটিক আছে, সেসব জেনেটিক দিয়ে আমাদের দেশীয় জাতের গরুর সংক্রায়নের মাধ্যমে আবহাওয়া উপযোগী জাত উন্নয়নে চেষ্টা করা হচ্ছে।

সরকার প্রাণিখাদ্য আমদানিতে শুল্কসুবিধা দিয়ে আসছে। সেটা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আমাদের যেসব নদীর চর আছে বা খাস জমি আছে, সেগুলো যদি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাথে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটা বন্দোবস্ত করা যায় তাহলে গোখাদ্যের জন্য এসব জমি খামারিদের লিজ দিতে পারে। এসব জমিতে উন্নতমানের ঘাস চাষ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, দেশে দুধে উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে গোখাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, গরুর উন্নতজাত এবং চারণভূমির ব্যবস্থা করা বা সবজু ঘাস খাওয়ানো নিশ্চিত করা, এতে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। সর্বোপুরি বিপণন ব্যবস্থায় খামারিকে যুক্ত করে এটিকে আরো শক্তিশালী করা যাতে খামারি এবং ভোক্তাদের মধ্যে (দাম নিয়ে) একটা সমন্বয় থাকে।

প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরই) সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে ১৩-১৪ শতাংশ হারে দুধের উৎপাদন বাড়ছে। এভাবে বাড়লে ৫-৭ বছরের মধ্যে দেশে দুধের ঘাটতি থাকবে না। তবে উৎপাদন বাড়লেও কেন দাম বাড়ছে? আমাদের আসলে উৎপাদন খরচ কমানো দরকার। যাতে মানুষ সুলভ মূল্যে দুধ খেতে পারে। মিল্ক প্রডাকশন টেকনোলজিতে গুরুত্ব দেয়া দরকার। উন্নত জাত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে দুধের ব্যবহার বাড়বে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/839363