৩১ মে ২০২৪, শুক্রবার, ১২:৩১

বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস : ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’

ডলার সঙ্কটের মধ্যেই আরেকটি নেতিবাচক খবর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ১৪ শতাংশের মতো।

পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশীদের পুঁজি নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ২০২২ সালে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার।

সেখানে গত বছর এটা নেমে গেছে তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে। অন্যদিকে ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেয়া হয়েছিল ছয় কোটি ৪৭ লাখ ডলার। গত বছর নেয়া হয়েছে সাত কোটি ৩২ লাখ ডলার। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যদিকে দুর্বল অবকাঠামো, সংস্কারের ধীরগতি ও অর্থায়নে অসুবিধার কারণে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশেরও অবনতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্সে (বিবিএক্স) এ তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।

বিদেশীরা কেন বিনিয়োগ কমিয়ে উল্টো পুঁজি নিয়ে যাচ্ছে? জানতে চাইলে হামীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য এ কে আজাদ বলেন, ‘আমরা যখন বিদেশীদের বিনিয়োগের কথা বলি, তখন তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস দেয়ার আশ্বাস দেই। কিন্তু আমরা তো তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারছি না। পাশাপাশি গ্যাসের চাপ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমাদের কারখানাগুলোতেই ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা কেন বিনিয়োগ করবেন? আবার সবাই তো বিনিয়োগ করা অর্থ বা লভ্যাংশ ফেরত নিতে চায়। কিন্তু ডলার সঙ্কটের কারণে তারা লভ্যাংশও নিতে পারছে না। এসব কারণেই হয়ত বিদেশী বিনিয়োগ কমছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দেশে সরাসরি বৈদেশীক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে রেকর্ড পরিমাণে। এফডিআই কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, নিট হিসাবে কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে বৈদেশীক ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ৪৮২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে এসেছে ৩৯৬ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড। অতীতে এত বেশি হারে কখনোই এফডিআই কমেনি। বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাংলাদেশে এফডিআই কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০২১ সালের তুলনায় এফডিআই বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১ সালে এফডিআই এসেছিল ৩৮৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগ কমার অনেকগুলো কারণ আছে। শুধু একটি কারণে তো আর বিদেশী বিনিয়োগ কমে না, একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক আছে। প্রথমত সুশাসন। অর্থাৎ দুর্নীতি কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো ও যোগাযোগ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে হচ্ছে তাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মতো না। প্রয়োজনীয় যোগাযোগগুলো আরো বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এখানে মানুষ হয়রানির শিকার হন। বন্দরের ব্যবস্থাপনা গতিশীল করতে হবে। এরপর রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। একটা ফাইল, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে লম্বা সময় লাগে। এটাও কমাতে হবে। এছাড়া সরকারের পলিসিতেও সঙ্কট আছে। আমাদের ট্যাক্স পলিসিও ব্যবসা বান্ধব না। সবকিছু মিলিয়েই বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরের ব্যবধানে বিদেশ থেকে পুঁজি হিসাবে এফডিআই আসার প্রবণতা কমেছে ৩১ শতাংশ। ২০২২ সালে পুঁজি হিসাবে এফডিআই এসেছিল ১০২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে এসেছে ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। ২০২১ সালের তুলনায় পুঁজি হিসাবে এফডিআই আসার প্রবণতা আরো কম অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ কমেছে। ২০২১ সালে পুঁজি হিসেবে এফডিআই এসেছিল ১১৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। গত তিন বছরের মধ্যে গত বছর বিদেশী পুঁজি সবচেয়ে কম এসেছে।

এফডিআইয়ের প্রবাহ কমায় ও দেশ থেকে পুঁজি তুলে নেয়ায় দেশে এফডিআইয়ের স্থিতিও কমেছে। ২০২২ সালে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল দুই হাজার সাত কোটি ৫৫ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে তা আরো কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫৪ কোটি ৯২ লাখ ডলারে। একই সময়ে নিট এফডিআই কমেছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় এফডিআইয়ের স্থিতি কমেছে আরো বেশি, অর্থাৎ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই বছরে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল দুই হাজার ১৫৮ কোটি ১৯ লাখ ডলার। গত তিন বছরের মধ্যে এফডিআইয়ের স্থিতি এখন সবচেয়ে কম।

এফডিআইয়ের স্থিতিও কমার কারণ জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের সাবেক অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এর মূলত তিনটি কারণ। একটি কারণ সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। সেটা হলো গত দুই বছর ধরে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি অত্যন্ত চাপের মুখে আছে। এই চাপ থেকে বের হতে ডলারের প্রয়োজন। সেটার সরবরাহ তো বাড়ছে না। আবার দেখেন আমাদের নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণ ঘটছে। সেখানে আমরা যাদের সাথে প্রতিযোগিতা করছি সেই ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতের চেয়ে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো না। বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতাও বাড়েনি। ব্যবসার পরিবেশ, বাণিজ্য নীতি, লজিস্টিক খাত ও পুরোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো এর পেছনের কারণ।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছে বিনিয়োগ এসেছে ৩৬৬ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩১৪ দশমিক নয় মিলিয়ন ডলার, চীন থেকে ২৫৯ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৮১ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার ও নরওয়ে থেকে ১৭৬ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, পণ্য সরবরাহে ঝামেলা হওয়া, বৈদেশীক চাহিদায় মন্দা ও হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার কারণে চলতি মাসের শুরুতে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। ২০২১ সালের আগস্টে তা ছিল ৪০ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সীমাবদ্ধ করতে বাধ্য হয়। গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে ৩৪ শতাংশ।

ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবীর বলেন,‘বিদেশী বিনিয়োগ কমার কারণ আমরা বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে আমরা দেখেছি, সরকারের কিছু রেগুলেশনে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। ধরেন, প্রনোদনা পেয়ে কিছু বিনিয়োগ হয়েছিল। এক বছর পরই সেই প্রনোদনা তুলে নেয়া হলো। এরপর তাদের ওপর এসডি, ভ্যাট চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এখন বিদেশীরা তো এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করেন না। তারা দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা নিয়ে আসেন। অনেক সময় তারা বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেও ধারণা নেন। সেখানে যদি তারা দেখেন পলিসিতে অনিশ্চয়তা আছে, তাহলে তো তারা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না।’

এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দেশে ব্যবসার পরিবেশের আরো অবনতি হয়েছে। এবার ব্যবসা পরিবেশ সূচকে অর্জিত পয়েন্ট হয়েছে ৫৮ দশমিক ৭৫, যা গত আগের অর্থবছরে ছিল ৬১ দশমিক ৯৫। চলতি অর্থবছরের ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্সে (বিবিএক্স) তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার এমসিসিআইয়ের গুলশান কার্যালয়ে এ জরিপের চিত্র তুলে ধরা হয়। তৃতীয়বারের মতো বিবিএক্স জরিপ পরিচালনা করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ। ব্যবসায়ীদের মধ্যে করা জরিপের মাধ্যমে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে

https://dailyinqilab.com/national/news/661845