৩১ মে ২০২৪, শুক্রবার, ১২:১৩

এখনও পানির নিচে কয়রা পাইকগাছা দাকোপের অনেক গ্রাম

ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতের তিন দিন পরও পানির নিচে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন গ্রাম। এসব স্থানে বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামতে তিন দিন ধরে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় মানুষ। সকালে মেরামতের পর দুপুরের জোয়ারের চাপে বিকল্প বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এতে প্লাবিত হচ্ছে আশপাশের গ্রাম। পাউবো কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা জানান, রিমালের আঘাতে খুলনা জেলার তিন উপজেলার আট পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে যায়। এতে প্লাবিত হয় শত শত বাড়িঘর, মাছের ঘের ও ফসলি জমি। বিরামহীন চেষ্টার পর পাঁচটি পয়েন্টে বাঁধ মেরামত সম্ভব হয়েছে। তবে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের দক্ষিণ কামিনীবাসিয়া

এবং পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের পেড়িখালী গ্রামের ভাঙা বাঁধ দিয়ে এখনও পানি ঢুকছে। সরেজমিন দেখা যায়, দাকোপের দক্ষিণ কামিনীবাসিয়া গ্রামে বাঁধ মেরামতের জন্য সকাল থেকে কাজ শুরু হয়। বাঁধের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হতেই জোয়ার চলে আসে। জোয়ারের চাপে এক পর্যায়ে পানিতে ভেসে যায় বিকল্প বাঁধ। এতে তিলডাঙ্গা ও পানখালী ইউনিয়নের ২০ থেকে ২২টি গ্রাম তলিয়ে যায়। একই দৃশ্য দেখা গেছে কয়রার দশহালিয়া গ্রামে। বুধবার সকালে দুই শতাধিক মানুষ মূল ভাঙনে কাজ শুরু করেন। দুপুরের আগেই বাঁধটির ৮০ শতাংশ মেরামত কাজ শেষ করা হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে নদীতে পূর্ণ জোয়ারের সময় পানির চাপে তা ভেঙে যায়। এতে ওই গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর ফের পানিতে তলিয়ে যায়।

দাকোপের তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসী গ্রামের বাসিন্দা মিলন কান্তি মন্ডল ও নিয়ামত শেখ আলী বলেন, বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করেছে। এবারের ঝড় দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এতক্ষণ কোনো ঝড় কখনো দেখি নি। বাঁধটি আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের চেষ্টা করছি। এখানের ছয়টি পয়েন্টা বাঁধ ভেঙেছে। জোয়ার আসলেই এসব পয়েন্ট থেকে পানি প্রবেশ করে লোকালয় তলিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠ ও ঘের তলিয়ে যায়। রান্না ঘরও তলিয়ে গেছে। কিছু রান্না করে খাব সেই অবস্থা নেই। মুড়ি-চিড়ে খেয়ে বাঁধ মেরামতে কাজ করছি। লবণ পানির কারণে গাছ মারা যাচ্ছে। তারা বলেন, পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। অনেক স্থানে রুই-কাতলা ও মৃগেল মাছ মরে ভাসছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। জনপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দেয় কিন্তু বাঁধ নির্মাণ হয় না। আমরা টেকসই মজবুত বেড়িবাঁধ চাই। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি চাই।

তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন গাজী বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তা-বে ইউনিয়নের অধিকাংশ জায়গা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। মানুষ অনেক কষ্টে রয়েছে। ভাঙা বাঁধের ৬-৭টি পয়েন্ট থেকে এখনো জোয়ারের পানি ঢুকছে। মানুষ রাস্তায় রান্না করে খাচ্ছে। ২০০/৩০০ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। তবে জোয়ার আসলে আবারও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের বাসিন্দা বিজন বিহারী সরদার বলেন, প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের গল্প শুনি। কিন্তু আমাদের বাঁধের কিছু হয় না। লবণ জলে ডুবতে ডুবতে জীবন শেষ। লবণের চিংড়ি চাষ থেকে বাঁচতে চাই। এতো ক্ষতি, কোনো ক্ষতিপূরণও পাই না। আমাদের এ দুর্যোগ থেকে বাঁচান। বাঁধ মেরামতের কাজে আসা লোকজন জানান, মঙ্গলবার সকালে ঘূর্ণিঝড় রেমালের দাপট কমে যায়। এ সময় কপোতাক্ষ নদে জোয়ারের চাপও একটু কমে আসে। ওই সময় গ্রামের মানুষ ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে বাঁধ মেরামতে লেগে পড়ে। প্রথম দিনে ভেঙে যাওয়া বাঁধের নিচের অংশে বাঁশের চালা পুঁতে সেখানে বালুর বস্তা ফেলে রাখা হয়। এতে লোকালয়ে পানির চাপ অনেকাংশে কমে যায়। এ অবস্থায় বুধবার সকালে দুই শতাধিক মানুষ মূল ভাঙন মেরামতে কাজ শুরু করে। দুপুরের আগেই বাঁধটির ৮০ ভাগ মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে নদীতে পূর্ণ জোয়ারের সময় পানির চাপে তা ভেঙে যায়। ওই বাঁধ মেরামত কাজে অংশ নেয়া স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসক নুরুল ইসলাম জানান, কাজ করার মানুষ যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সময় মতো কাজের সরঞ্জামাদি জোগান দিতে পারেনি পাউবোর কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বালু ভর্তি বস্তার অভাবে মেরামত সম্পন্ন বাঁধটি টিকিয়ে রাখা যায় নি। বাঁধের ঢালে বালু ভর্তি বস্তাগুলো ফেলা গেলে বাঁধটি হয়তো টিকে থাকতো।

সাবেক ইউপি সদস্য শাহাদাত হোসেন, স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুল, আরাফাতসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, দশহালিয়ার ওই স্থানটি বারবার ভাঙছে। দুই বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ সংস্কার করলেও ফের ভেঙেছে। মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ হাত বদল হওয়ায় মানসম্মত হয় না। মূল ঠিকাদার থেকে কাজ সম্পন্ন করা শ্রমিক সরদার পর্যন্ত কয়েকটি দফায় লভ্যাংশ রেখে হাত বদল হয়। ফলে বরাদ্দের দশ শতাংশ টাকারও কাজ হয় না বলে অভিযোগ তাদের। কাজ মানসম্মত হয় না। যতটুকু চওড়া উঁচু করার কথা থাকে সেটা করেন না। কাজের সাইটে কোন সাইনবোর্ডও দেয়া থাকে না। খুবই নিম্নমানের কাজ হাওয়ায় একই স্থান থেকে বারবার বাঁধ ভাঙছে। মহারাজপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু বলেন, বাঁধ না ভাঙা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্ব দেয় না। তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে আজ আমরা পানিবন্দি। তিন দিন হলো এখান থেকে জোয়ার ভাটায় পানি উঠানামা করছে, এরপরেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম উদাসীনতা রয়েছে। বালু পূর্ণ জিও ব্যাগ দেওয়ার কথা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড সেটা এখানে পৌঁছাননি। তাদের গাফিলতিতে আজও পানি আটকানো সম্ভব হয়নি। পাউবোর কয়রার দায়িত্বশীল উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেন, মেরামত কাজে যাদের বালু সরবরাহের কথা ছিল শেষ মুহূর্তে এসে তারা ব্যর্থ হন। তবুও এলাকার মানুষকে সাথে নিয়ে বাঁধটি মেরামতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে যেখান থেকে বাঁধ ভেঙেছে সেখানে আগে ডাম্পিং করা কিছু সিনথেটিক ব্যাগ মাটির সঙ্গে মিশে আছে। তার ওপরে পুনরায় মাটি চাপা দেওয়া হয়। জোয়ারের চাপে ব্যাগের ওপরের অংশের মাটি ধসে যাওয়ায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

পাউবোর খুলনা নির্বাহী প্রকৌশলী-২ আশরাফুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে আট স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকে। প্রথম দিন পাঁচ স্থানে বিকল্প বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়। তবে তিনটি স্থানে তিন দিন চেষ্টা করেও বাঁধ টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। তিনি বলেন, আপাতত বিকল্প বাঁধ তৈরি করে পানি ঢোকা বন্ধ করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত স্থান স্থায়ীভাবে মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হবে।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা জনগণের সাথে থেকেই সার্বক্ষণিক তদারকি করছি। বাঁধ নির্মাণের সকল সরঞ্জামাদি আমরা সরবরাহ করছি। শ্রমিকের মজুরিও পরিশোধ করা হবে। এদিকে পাইকগাছায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হওয়া গড়ইখালীর খুদখালী বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে আটকালেও চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। অপরদিকে গড়ইখালী ইউনিয়নের প্রায় ৩শ’ পরিবার এখনো পানিবন্দী। ইউপি চেয়ারম্যান পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করায় ঘরের ভিতরের পানি নামলেও এখনো উঠানে রয়ে গেছে। বর্তমানে ঐ এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী এলাকায় খুলনা জেলা জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর জেরিকন, বালতি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, হাইজিন কিট, ব্লিচিং পাউডার ও প্লাস্টিকের সেমি টুল বিতরণ করেছে। গড়ইখালী ইউপি চেয়ারম্যান জি এম আব্দুস ছালাম কেরু বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকা খুদখালী ওয়াপদার বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হয় এবং ৫০/৬০টি ঘর-বাড়ি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়। গত দুই দিন ধরে এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ভাঙন স্থানে কাজ করে কোন রকমে পানি আটকানো হয়েছে। কিন্তু জোয়ারের পানিতে যে কোন সময় আবারো ওই স্থান ভেঙে যেতে পারে। এদিকে উপজেলার লস্কর, সোলাদানা, দেলুটি, লতা, রাড়ুলি, গদাইপুর, কপিলমুনি, হরিঢালী ও চাঁদখালী ইউনিয়নে ভেঙে যাওয়া কিছু কিছু বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মেরামত করা হলেও বাকি স্থানে বাঁধ মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। খুলনা জেলা জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামালুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন ও ইউপি চেয়ারম্যান জি এম আব্দুস ছালাম কেরু পানিবন্দী এলাকা পরিদর্শন করে তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা শোনেন।

https://dailysangram.info/post/557608