২৯ মে ২০২৪, বুধবার, ৪:৫৭

চাকরির শেষ তিন বছরেই কেনেন ৪৬৬ বিঘা জমি

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে আইজিপি পদটিই যেন ‘আলাদীনের চেরাগ’। বেনজীর আহমেদ পুলিশের সর্বোচ্চ এই পদে পদায়ন হওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা হয় ৪৬৬ বিঘা জমি। ১৯টি প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে হয়ে যায় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী পরিবার।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার আগে এই বছরগুলোয় তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানের নামে ৪৬৬.৭৯ বিঘা জমি কেনেন। বিভিন্ন দাগ ও খতিয়ান অনুযায়ী, ১৬৩ দলিলে কেনা হয় এসব জমি। একই সময়ে ফ্ল্যাট-প্লটের বাইরে দেশে ব্যবসারত ১৯টি কম্পানির মালিকানা কেনা হয়েছে বেনজীর পরিবারের নামে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি ফান্ড ও সঞ্চয়পত্রেও করেন বিপুল বিনিয়োগ।
বেনজীর আহমেদ গত ২০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া ভিডিও বার্তার ৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ড সময়ে পারিবারিক কৃষি খামার ও কৃষি বিনিয়োগ থেকে আয়ের দাবি করেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের সাহাপুরে বেনজীর আহমেদের পরিবারের যে কৃষি ও মৎস্য খামার রয়েছে, সেটি তিনি পারিবারিক সূত্রে পাননি। বর্তমানে সাভানা অ্যাগ্রো ফার্ম নামের তাঁর কৃষি খামারটি পৈতৃক ভিটা টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাছি ইউনিয়নের ডিমাডাঙ্গা গ্রাম থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে।

এলাকাবাসী জানায়, বেনজীর আহমেদ সাহাপুরে ২০১০ সাল থেকে জমি কেনা শুরু করেন।
সেই থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। ১৫টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। বেনজীরের দাবি অনুযায়ী, ১৫টি পুকুরের মাছ চাষ দিয়ে এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয় বলে মত দেয় তারা। বরং এসব পতিত জমি চাষ ও বাসের উপযোগী করতে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বেনজীর আহমেদ। অর্থে কেনা এ খামার থেকে এত টাকা আয় করা সম্ভব নয়।

গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১’ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ২ এপ্রিল ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’ ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত দুদকের পাওয়া সম্পদের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। এর পর থেকে আগ্রাসীভাবে জমি কেনা শুরু করেন নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে। ২০২০ সালে ১২ দলিলে ৪৬.৫৭ বিঘা জমি কেনে বেনজীর পরিবার। যার দলিল মূল্য দেখানো হয় প্রায় এক কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ সময় গোপালগঞ্জ সদর ও টুঙ্গিপাড়ায় এ জমি কেনে তারা। এর মধ্যে স্ত্রী জীশান মীর্জা সাভানা ফার্ম প্রডাক্টের নামে ১০টি দলিলে জমি কেনেন।
২০২১ সালে ৯১ দলিলে ২১৯.৭৭ বিঘা জমি কেনেন জীশান মীর্জা। যার দলিল মূল্য দেখানো হয় মাত্র সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত কেনা হয় ২০০.৪৪ বিঘা জমি। যার দলিল মূল্য দেখানো হয় মাত্র ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এর আগে ২০০৯ সালে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জেএল ০২, আরএস ১৯৬-এর দাগ নম্বর ৫১১০, ৫১১১ ও ৫১১২-এ ৪০ শতাংশ জমি কেনেন বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা। এর মধ্য দিয়ে জমি কেনার হাতেখড়ি হয় বেনজীর পরিবারের। ওই সময় জীশান মীর্জা ৪০ শতাংশ জমি কেনেন পাঁচ লাখ টাকায়। প্রথম জমি কেনার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন দলিলে বেনজীর আহমেদ নিজের নামে কেনেন ১৭৫ শতাংশ বা ৫.৩০ বিঘা জমি। ওই সময় জমির দলিল মূল্য দেখানো হয় ৫৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালে বেনজীর আহমেদের জন্মস্থান গোপালগঞ্জে জমি কেনা শুরু করেন তিনি। এ সময় তিনি জনৈক আবু সাইদ মো. খালেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা ও বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের নামে পাঁচটি দলিলে ৯৮০ শতাংশ জমি কেনেন। পৃথক পাঁচটি দলিলের সর্বমোট দাম দাঁড়ায় ৪০ লাখ দুই হাজার টাকা। এ ছাড়া ২০১৭ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরে বেনজীর ও তাঁর পরিবার ২২টি দলিলে ১১৬.২৪ বিঘা জমি কেনে। জমিগুলোর দাম হয়েছিল চার কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ৩৩টি দলিলে ১৫২.৮৫ বিঘা জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য পাঁচ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

২০২টি দলিলে বেনজীর ও তাঁর পরিবার জমি কিনেছে। এর মধ্যে ১৯৬টি দলিলে ২০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার জমি কেনা হয়। এ ছাড়া দুটি দলিলের মূল্য এখনো পাওয়া যায়নি। এদিকে ঢাকার গুলশানের ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাটের দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা। ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি করা হয় ২০২৩ সালে। চারটি ফ্ল্যাটই এক দিনে কেনেন তিনি। সাভারে পাঁচ কাঠার একটি জমির তথ্য পেয়েছে দুদক। তবে তার দলিল মূল্য জানা যায়নি। এ ছাড়া গোপালগঞ্জে সাভানা ফার্ম প্রডাক্টস, সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা ইকো রিসোর্ট, সাভানা কান্ট্রি ক্লাব, একটি শিশির বিন্দুসহ প্রায় ১৯টি কম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে বেনজীর পরিবারের।

পুলিশের সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

তিনি বলেন, ‘নরমালি প্র্যাকটিস হলো কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁর নিজের এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবেন না। আইনে কী আছে তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, আমি যে এলাকায় চাকরি করছি, সেই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলে অন্যায়ভাবে অনেক কিছু করার চেষ্টা করব। এই সুযোগটা থেকেই যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, প্রথমত, কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি এই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, সরকারি চাকরি করে তিনি ব্যবসা করবেন, এটি কোনোভাবেই সাংবিধানিক অধিকার হতে পারে না। তবে এখানে একটা কথা আছে, ফ্যামিলি বলতে ভাই, মামা, চাচা, খালু, ফুফারা ব্যবসা করতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র, সন্তানদের ব্যবসা করার সুযোগ নেই।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/05/29/1392370