২৯ মে ২০২৪, বুধবার, ৩:৫৬

পাঠ্যপুস্তকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন

-অধ্যাপক মো: নাছির উদ্দিন খান

শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য একজন নাগরিককে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও পেশাগত জীবনের দায়িত্ব নৈতিকতার সাথে পালনে সক্ষম করে তোলা। আর এটা নিশ্চিত করা হয় দেশের জনগণের বোধ-বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতি রেখেই। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় তা উপেক্ষিত থেকে গেছে। বরং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা হতে ধর্ম ও নৈতিকতাকে সরিয়ে ফেলে, মৌলিক দর্শন হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ও সেক্যুলারিজমকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। শিক্ষানীতি ২০১০ এর প্রাককথনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই শিক্ষানীতির উল্লেখ্যযোগ্য দিক হলো এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।’ এই শিক্ষানীতির অধ্যায়-২ ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ নির্ধারণের ৩০টি পয়েন্টের ওপর নীতিগত তাগিদ দেয়া হয়েছে যার ২-পৃষ্ঠায় ১৬নং পয়েন্টটি এরূপ ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্রগঠনে সহায়তা করা।’ ২১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘নৈতিকতার মূল উৎস হচ্ছে ধর্ম শিক্ষা।’ বাস্তবে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি সংসদে পাস হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ ধর্ম শিক্ষাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এ তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং সুকৌশলে ধর্ম তথা ইসলাম শিক্ষাকে প্রকারান্তরে বাদ দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘সংসদে আলোচনা ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়েছে’ (দৈনিক শিক্ষা)। সরকার জাতিকে তথ্য জানিয়েছেন একরকম। কিন্তু বাস্তবে জাতিকে অন্ধকারে রেখে বাস্তবায়ন করছেন অন্যরকম।

NCTB এর সিলেবাসে বিজ্ঞান শিক্ষা কোথায়? বিজ্ঞান শিক্ষাকে যেভাবে সঙ্কুচিত করা হয়েছে বিশ্বের কোথাও এভাবে সঙ্কুচিত করার নজির নাই। ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম, সঙ্গীতের স্বরলিপি, নাচ, গান, অভিনয়, ট্রান্সজেন্ডার ও যৌন শিক্ষার জ্ঞানের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কি বিজ্ঞান শিখাবেন? নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের মন্তব্য- ‘মন্ত্রী, আমলা এবং দলীয় বড় বড় নেতাদের মধ্যে যারা এই নতুন কারিকুলামের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাদের একজন সন্তানও নতুন কারিকুলামে বা বাংলামাধ্যমে লেখাপড়া করছেন না।’ বরং এই কারিকুলামে লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছে মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত এবং বাংলার কৃষকের সন্তানরা। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ জনগণের সন্তানরা শ্রমিক, কেরানি ও আমলাদের সেবাদাস ছাড়া আর কিছুই হতে পারবে না।

নতুন কারিকুলামে খুব সূক্ষ্মভাবে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী যে সকল বিষয় রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ :

১. শিল্প ও সংস্কৃতির নামে ইসলামী সংস্কৃতি মুছে ফেলা।

২. একমুখী শিক্ষার নামে মাদরাসা শিক্ষাকে নির্বংশ করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা।
৩. বিজ্ঞান শিক্ষা সংকোচনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধাকে ধ্বংস করে জাতিকে পরনির্ভরশীল করার পাঁয়তারা।
৪. শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কোন ধর্মীয় পরিচয় যাতে না থাকে এভাবে তাদের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করা।
৫. মানব সভ্যতা বিধ্বংসী ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ ও যৌনাচারকে প্রমোট করা।
৬. পৌত্তলিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির আধিপত্য, অর্থাৎ ডি-ইসলামাইজেশনের পাঁয়তারা।
৭. মুসলিমদের অবদান গোপনের চেষ্টা যেমন-
ক) ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ১২০ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উল্লেখ করার মাধ্যমে মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মত্যাগের ইতিহাসকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে যা মূলত ইতিহাস বিকৃতি ও মুসলিমদের অবদান গোপনের মারাত্মক অপচেষ্টা।
খ) মুসলিম শাসকদের ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়া।
গ) মুসলিম শাসকদের অত্যাচারী শাসক হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা।
৮. ‘কৃষি শিক্ষা’ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করা হচ্ছে।

৯. ‘গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে’ মেয়েদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সফল হওয়ার কৌশল শিখানো হতো। কিন্তু এই শিক্ষাকে বাদ দিয়ে আমাদের কোমলমতি মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে ড্যান্সার, নায়িকা, গায়িকা, অভিনেত্রী ইত্যাদি বানানোর প্রচেষ্টা মূলত পারিবারিক বন্ধনকে অশান্তির দিকে ধাবিত করা।
১০. পশ্চিমা মতবাদের বয়ান।
২০২৪ সালের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে যা ইতঃপূর্বে ছিল না। এর ব্যাপকতা অনেক। সেখান থেকে সামান্য কিছু তথ্য প্রমাণ এখানে উপস্থাপন করা হলো-
ক) ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ইবতেদায়ি প্রথম শ্রেণীর ইংলিশ ফর টু ডে বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের পরস্পর কথোপকথনের সময় সালাম বিনিময় ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে সালাম মুছে ফেলে যেখানে ‘গুড মর্নিং’ শব্দ দেয়া হয়েছিল এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষেও তা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
খ) ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বই এর ৩৯ পৃষ্ঠায় দেশীয় সংস্কৃতির নামে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ঢোল-তবলা উপস্থাপন করা হয়েছে।
গ) এছাড়া সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই : ১৮, ৯৫ ও ৯৬ পৃষ্ঠা, চতুর্থ শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়; ৮৪ পৃষ্ঠাসহ অনেক ক্ষেত্রেই ডি-ইসলামাইজেশন করা হয়েছে।
ঘ) ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে যে, ‘আমার মা কপালে চুমু দিলেও, আমি হয়তো আমার বন্ধুকে চুমু দিতে দিব না। তবে সে একই বন্ধুর সাথে হাত ধরে ঘুরতে হয়তো আমার অস্বস্তি লাগবে না।’ এখানে মেয়ে নাকি ছেলে বন্ধু তা উল্লেখ করা হয়নি। আবার চুমু খেতে হয়তো না দিলেও হাত ধরে ঘুরতে-বের হতে তেমন বাধা নেই।
আজকে সমাজে অসংখ্য কিশোর কিশোরীরা পিতা-মাতার অজান্তে বন্ধুর হাত ধরে নিখোঁজ হচ্ছে এবং ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের সভ্য সমাজকে পশ্চিমাদের মতো অসভ্য অবাধ যৌনতার সমাজে পরিণত করার কূটকৌশল বৈ কিছুই নয়।
ঙ) সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শরিফ ও শরিফার গল্প আলোচনা করা হয়েছে। ২০২৩ সালে উক্ত বইয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সারা দেশব্যাপী প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নিয়ে ২০২৪ সালেও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে ট্রান্সজেন্ডারকে তালগোল পাকিয়ে পাশ্চাত্য থেকে আমদানীকৃত সমকামিতা বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

চ) এই কারিকুলাম একমুখী হওয়ায় জেনারেল সাবজেক্টগুলো হুবহু স্কুল শিক্ষার সিলেবাস থেকে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যবই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাঠ্যবইগুলোতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা মাদরাসা শিক্ষার বোধ-বিশ্বাসের বিপরীত।
ছ) পাঠ্যবইয়ের বিষয় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপ ডিসকাশন করতে হয়, গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়। শিক্ষার্থীদের এ বিষয় ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এগুলো ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করতে গেলে সে পর্নোগ্রাফির মুখোমুখি হবে। এভাবে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আলোচনার মাধ্যমে লজ্জার বাঁধন উঠে যাবে এবং যেকোনো অনৈতিক কাজে তাদের অনায়াসে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জ) অষ্টম শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের ভাষার চেয়ে সাহিত্য বেশি। আমরা মনে করি অনার্স-মাস্টার্স লেভেলের গল্প ও কবিতার পাঠ অষ্টম শ্রেণিতে নিয়ে আসা হয়েছে। এই বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য এই সাহিত্যের জ্ঞান অর্জন করতে পারা ততটা সহজ নয়। ফলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ভীতি সৃষ্টি করবে।
আমাদের দাবিসমূহ : ০১) বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম-২০২১ বাতিল করা এবং যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক এবং দ্বীনদার শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করা।
০২) পাঠ্যপুস্তকের সব বিষয় হতে বিতর্কিত ও ইসলামী আকিদাবিরোধী প্রবন্ধসমূহ বাদ দেয়া। স্কুল ও মাদরাসার সব পাঠ্যপুস্তক বিজাতীয় সংস্কৃতি, অনৈসলামিক শব্দ এবং অশ্লীল চিত্রমুক্ত রাখা।

০৩) মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম শিক্ষানীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী মাদরাসা সংশ্লিষ্ট আলেম, দ্বীনদার, ইসলামিক স্কলার শিক্ষকদের দ্বারা পরিমার্জন করা ও আলিয়া মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্র কারিকুলাম প্রণয়ন করা।
০৪) শিক্ষকদের স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন কাঠামো এবং শিক্ষক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে।
০৫) প্রকৃতি বিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতি বিরোধী ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাতিল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডার কোটা বাতিল করা। সমাজে অবহেলিত হিজড়া জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে সুুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা
০৬) ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি স্ব-স্ব ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এবং পাঠা-পুস্তকের নামকরণ নিজ ধর্মের নাম অনুসারে করা।
০৭) নৈতিকতা সমৃদ্ধ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে সকল ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
০৮ ) শিক্ষার সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্র কর্তৃক বহন করা এবং ইবতেদায়ি মাদরাসাসহ সব এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।
০৯) পুরুষ ও মহিলা উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক বেকারত্ব ও খাদ্য ঘাটতির সমাধান এবং অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ‘কৃষি শিক্ষা’ ও ‘গার্হস্থ্য বিজ্ঞান’ শিক্ষা সব শ্রেণীর পাঠ্যসূচিতে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১০) শিক্ষা নিয়ে আপত্তি ও বিতর্কের ঝড় সমাধানের লক্ষ্যে নিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ, গবেষক, বুদ্ধিজীবী ও দ্বীনদার ইসলামিক স্কলারদেরকে নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করা।
লেখক : কেন্দ্রীয় সভাপতি, জাতীয় শিক্ষক ফোরাম

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/838511