২৫ মে ২০২৪, শনিবার, ৪:৩৯

জন্মসনদে জন্ম থেকেই পদে পদে যন্ত্রণা

জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে নগরবাসীর কপাল থেকে দুঃখ যেন মোচন হবার নয়। কখনও সার্ভার থেকে সনদ গায়েব হয়ে যাচ্ছে, কখনও সংযুক্ত হচ্ছে না ওয়েবসাইটে। আবার কখনও সনদ পেলেও তা দিয়ে স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট ইস্যু, ব্যাংক হিসাব খোলার মতো কোনো কাজই হচ্ছে না। তার ওপর রয়েছে এসব সনদ পেতে সীমাহীন ভোগান্তি।

বছরের পর বছর ধরে চলছে এ অবস্থা। নগরবাসীর ভোগান্তি এড়াতে উত্তর সিটি করপোরেশন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে নিবন্ধনের কাজ স্থানান্তর করলেও ভোগান্তির নিরসন হয়নি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) পৃথক সার্ভারে নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করায় নগরবাসীর ভোগান্তি আরও বেড়েছে। কোনো সংস্থাই তাদের ইস্যু করা জন্মসনদ গ্রহণ করছে না।

২০০৭ সালে জন্মমৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে সরকার। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মসনদ গ্রহণসহ প্রত্যেক নাগরিকের এটা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। শিশুর স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে ১৯ ধরনের সেবা পেতে এই জন্মসনদের প্রয়োজন পড়ে।

জন্মমৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। কিন্তু এই কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে কখনোই পরিচালিত হয়নি। সংস্থাগুলো প্রথমে হাতে লেখা সনদ ইস্যু করলেও এক পর্যায়ে গিয়ে কর্তৃপক্ষের মনে হয়, এই কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করা প্রয়োজন। ২০১২ সালে অনলাইন সার্ভারের মাধ্যমে সনদ ইস্যুর কার্যক্রম শুরু হয়। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে সারাদেশে শুরু হয় নিবন্ধন কার্যক্রম। তখন বলা হয়, হাতে লেখা সনদগুলোর তথ্য ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু যেসব দপ্তরে কম্পিউটার-ইন্টারনেট নেই সেসব দপ্তর হাতে লেখা সনদই ইস্যু করতে থাকে। পরে কিছু সনদ ওয়েবসাইটে যুক্ত হয়। তবে দেড় যুগ পরও বেশির ভাগ সনদ যুক্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো।
২০১৭ সালে বলা হয়, যেসব সনদ সার্ভারে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি, তাদের নতুন করে সনদ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি চলতে থাকে সার্ভার ডাউন-সংক্রান্ত সমস্যা। এক পর্যায়ে ২০২১ সালে নতুন আরেকটি সার্ভারে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। পুরোনো সার্ভারের ডাটা নতুন সার্ভারে যুক্ত করার কথা বলা হয়। এক পর্যায়ে পুরোনো সার্ভারটি ক্রাশ করে। ৭ কোটি মানুষের জন্মসনদ ওই সার্ভার থেকে গায়েব হয়ে যায়। এসব নাগরিককে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। তাদের সামনে একটাই বিকল্প– আবার নতুন করে জন্মসনদ গ্রহণ।
সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে আরও বড় ভোগান্তি

জন্মনিবন্ধন নগরবাসীর ভোগান্তি নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে জন্মমৃত্যু নিবন্ধন সনদ কার্যক্রম শুরু করে। এর আগেই মে মাস থেকে ডিএসসিসি জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

কারণ জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যুতে সংস্থাটির যে ব্যয় হয়, তার বিপরীতে সরকার থেকে কোনো অর্থ পায় না।
এ ছাড়া এই কার্যক্রম নিয়ে বরাবরই দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ থাকায় ডিএসসিসির ঘাড়ে শুধু দুর্নাম জোটে। এ নিয়ে দফায় দফায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। মন্ত্রণালয় ডিএসসিসিকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। তখন ডিএসসিসি বলে, কেন্দ্রীয় সার্ভার ডাউন থাকার কারণে জন্মসনদ পেতে ভোগান্তি পোহায় নগরবাসী। এ জন্য ডিএসসিসি পৃথক সার্ভার তৈরি করে জন্মসনদ ইস্যু করবে। গত ৪ অক্টোবর নিজস্ব সার্ভার চালু করে ডিএসসিসি।

গত ১৯ মে পর্যন্ত ডিএসসিসি নিজস্ব সার্ভারের মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুর প্রায় ৭০ হাজার সনদ দিয়েছে। এর মধ্যে ৬৮ হাজার ৬০৪ টি জন্মসনদ এবং ১ হাজার ৭০টি মৃত্যুসনদ। কিন্তু এসব জন্মমৃত্যু সনদ সরকারি কোনো সংস্থাই গ্রহণ করছে না।

তারপরও ডিএসসিসি এই সার্ভারের মাধ্যমে সনদ ইস্যু করে যাচ্ছে। এসব জন্মসনদ নিতেও নগরবাসীকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। নেওয়ার পর যখন কোনো কাজ হচ্ছে না তখন ভুক্তভোগীরা ডিএসসিসির দ্বারস্থ হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের জানানো হচ্ছে, শিগগির কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু যুক্ত আর হচ্ছে না। ফলে অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডিএনসিসির কাছ থেকে আরেকটি সনদ সংগ্রহ করছে।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা
গত ১৩ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক আদেশে বলা হয়, ডিএসসিসি থেকে পৃথক সার্ভারের মাধ্যমে জন্মমৃত্যু নিবন্ধন সেবা প্রদান করা হলে নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এবং পাসপোর্ট সেবাসহ অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। এ জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সার্ভারের মাধ্যমে ডিএসসিসির জন্মমৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুরোধ করা হয়।

ইতোমধ্যে ডিএসসিসির সার্ভারে সম্পন্ন হওয়া যাবতীয় তথ্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সার্ভারে হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ডিএসসিসি কেন্দ্রীয় সার্ভারে এসব তথ্য হস্তান্তর করতে পারেনি।

একজনের ইউজার আইডি চালায় আরেকজন
জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যুর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সার্ভারে যুক্ত হওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সচিব, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের সার্ভারের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড রয়েছে। কিন্তু কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা এই আইডি আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে যাঁকে খুশি তাঁকে জন্মমৃত্যু সনদ দিচ্ছে।

এই সুযোগে বাংলাদেশি নাগরিক নয়, এ রকম একটি বড় গোষ্ঠী জন্মসনদ নিয়েছে। সেই সনদ দিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বানিয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়িও দিয়েছে। আবার ওই আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে একই ব্যক্তির নামে একাধিক সনদ ইস্যু করার ঘটনাও ঘটছে। ওয়েবসাইটে থাকা বিভিন্ন সনদের তথ্য পরিবর্তন করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

এসব ঘটনায় গত দুই মাসের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সচিব, কাউন্সিলরসহ অন্তত ২০ জনকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নকুল চন্দ্র দাসকে গত ২৪ এপ্রিল বরখাস্তও করা হয়েছে। তারপরও এ ধরনের জালিয়াতি ঘটেই চলেছে।

দায়িত্বশীলদের ভাষ্য
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শামছুল ইসলাম বলেন, এ-সংক্রান্ত বিষয়ে ডিএসসিসিকে জানানো হয়েছে। তারা এখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। পৃথক সার্ভারে এ কাজ করা চলবে না।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামছুল কবির বলেন, তারা এখন বঙ্গবাজার নির্মাণকাজের উদ্বোধন-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যস্ত আছে। অন্য দিকে কেউ কোনো নজর দিতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেল যাহিদ হোসেন বলেন, জন্মমৃত্যু নিবন্ধনের একটিই কেন্দ্রীয় সার্ভার। এর বাইরে গিয়ে ডিএসসিসি পৃথক যে সার্ভারের মাধ্যমে জন্মমৃত্যু সেবা দিয়ে যাচ্ছে তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেনি। এ কারণে তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের নির্ধারিত সার্ভারের বাইরে জন্মমৃত্যু সনদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ডিএসসিসি যেগুলো ইস্যু করেছে, সেগুলোর তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সেগুলোকে মূল সার্ভারে যুক্ত করার চেষ্টা করবে। অন্যথায় সেসব ব্যক্তিকে নতুন করে মূল সার্ভারের মাধ্যমে সনদ গ্রহণ করতে হবে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কেন্দ্রীয় সার্ভারে ডিএসসিসির সাইটের ডাটা স্থানান্তর করা কঠিন কোনো কাজ না। তারা চাইলেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে।

https://samakal.com/bangladesh/article/238869