২০ মে ২০২৪, সোমবার, ১০:৫১

লজ্জাহীনতার বার্তা শিশুদের মনে

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে-১

নতুন কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বিষয়। অবশ্য শুরু থেকেই অনেক বিষয় নিয়ে বিতর্কও চলছে। শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা শিশুদের পাঠ করার উপযোগী নয়। আবার শিশুদের পাঠ্যবইয়ে লজ্জাহীন নানা বিষয় যুক্ত করায় অনেক অভিভাবকও রীতিমতো ক্ষুব্ধ-বিরক্ত। শিশুদের সরল মনের সুযোগ নিয়ে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছে সমাজবিধ্বংসী ধর্মবিরোধী দর্শন। বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের মনে মগজে প্রোথিত করা হচ্ছে ধর্মহীনতার তকমা। শুধু ইসলাম ধর্মই নয় অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় পর্যালোচনা করে দেখা যায় পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেগুলো বিতর্কিতই শুধু নয় বরং ভিনদেশী কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের হীন অপচেষ্টারই নামান্তর। বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্ম শিক্ষা বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিকও বটে। পাঠ্যবই খুলে দেখা যায়, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে যেসব বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে তা শিশুদের জন্য পাঠ উপযোগী নয়। ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়গুলোকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা শিশুদের জন্য কোনো মতেই পাঠ-উপযোগী নয়।

সেখানে বলা হয়েছে কিভাবে একজন ছেলে বা মেয়ের আবেগপ্রবণতা বাড়ে। এ ছাড়া কিশোর-কিশোরীদের পরস্পরের প্রতি কৌতূহল সৃষ্টি হয়। মনের মধ্যে তীব্র আবেগ অনুভূতি অনুভব হয়। ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭, ৪৮ এবং ৪৯ নম্বর পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে এবং মেয়েদের শারীরিক গঠন, আকৃতি বিষয়েও খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে। ৪৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, মেয়ের মাসিক কখন বা কিভাবে শুরু। এ সময় করণীয় কী এসব বিষয়। আবার একই পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শরীরের যত্ন বিষয়ে বলা হয়েছে, ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকালে কিভাবে ছেলেদের বীর্য উৎপাদন শুরু হয়। শরীরের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বীর্য কখনো কখনো আপনা আপনিই শরীর থেকে বেরিয়ে যায়- এসব বিষয়েও বর্ণনা করা হয়েছে। আবার মেয়ের মাসিক শুরু হলে কিভাবে শুকনো কাপড় ব্যবহার করতে হবে। এই কাপড় কোথায় বা কিভাবে শুকাবে তাও বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের লজ্জার ও গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ্যে নিয়ে এসে ছেলেমেয়ে উভয়েরই লজ্জা ভেঙে দেয়া হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ের এসব লজ্জার বিষয়গুলো শুধু পাঠ্যবইয়েই রাখা হয়নি। লজ্জা ও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে ক্লাসরুমে খোলামেলাভাবে সবাইকে নিয়ে আলোচনা করতেও শিক্ষকদের দেয়া নির্দেশিকা বইয়ে বলা হয়েছে। আর এই পর্বকে বলা হয়েছে গ্রুপ ডিসকাশন। এই গ্রুপ ডিসকাশন ক্লাসরুমের কাজের মধ্যে বাধ্যতামূূলক করা হয়েছে।

যদিও মাত্র ক্লাস সিক্সের একজন শিক্ষার্থীর জন্য এতটুকু আলোচনা করা দরকার ছিল যে, তোমাদের শরীরে বয়ঃসন্ধকালের কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে তোমরা ছেলেমেয়েরা উভয়েই তোমাদের মা, বাবা, বড় ভাই কিংবা বোন বা ভাবীর সাথে আলোচনা করবে। তোমাদের সমস্যগুলো তাদের সাথে শেয়ার করবে। তারাই তোমাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন; কিন্তু উল্টো খোলামেলাভাবে ক্লাসরুমে ছেলেমেয়েদের একসাথে বসিয়ে গ্রুপ ডিসকাশনের নামে বেহায়াপনাকে উসকে দেয়া হয়েছে।

এ দিকে ষষ্ঠ শ্রেণীর তুলনায় সপ্তম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে আলোচনার ধারাবাহিকতায় আরো খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের বর্ণনায় মেয়েদের মাসিক এবং ছেলেদের বীর্যপাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে যেখানে ছেলেমেয়েদের একসাথে ক্লাসরুমে বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে আলোচনা করে লজ্জার বাঁধ ভাঙা হয়েছে আর সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে লজ্জাজনক বিষয়ে আরো খোলামেলা আলোচনা করে ছেলেমেয়েদের ব্যাপকভাবে ফ্রি মিক্সিং প্রমোট করা হয়েছে। মূল কথা এসব বিষয়ে আলোচনা করে ছেলেমেয়েদের একে অপরের কাছে আসার একটি বৈধ প্লট তৈরি করা হয়েছে। কেননা পাঠধারায় বলা হয়েছে, একটি সময়ে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। এর ফলে এই সময় কারো কারো মধ্যে আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

এখন একটি বিষয় স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে আর সেটি হলো সপ্তম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর (ছেলে বা মেয়ে) মধ্যে এই বয়সে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ থাকবে এটা প্রকৃতিগতভাবেই সত্য; কিন্তু এই বিষয়টিকে পাঠ্যপুস্তকে এভাবে ক্লাসরুমে আলোচনার মাধ্যমে বরং ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশাকে বৈধ, স্বাভাবিক এবং নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। একই সাথে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষক সহায়িকার ৫১-৫২ পৃষ্ঠাতে এসব বিষয়ে ক্লাসরুমে পাঠদানের কৌশলকে আরো উসকানি দেয়া হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণীর পর অষ্টম শ্রেণীতে আরো বেশি নির্লজ্জ ও উলঙ্গভাবে বর্ণনা করা হয়েছে মেয়েদের মাসিক নিয়ে। অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের একটি গল্পে সাথী নামের একটি মেয়ে তার মাসিকের ঘটনা ক্লাসরুমে গিয়ে গল্পের ছলে তার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করছে। এবার শুধু ক্লাসরুমের গ্রুপ ডিসকাশনে ক্ষান্ত না হয়ে একই বইয়ে সঞ্জয় ও আমেনার একটি গল্পে ইন্টারনেট ও গুগলের মাধ্যমে আরো বেশি জানার জন্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে শুধু পাঠ্যবইয়ে আবদ্ধ না থেকে বাইরের জ্ঞানও অর্জন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের একটি সহজাত ধর্ম। তবে এভাবে খোলামেলাভাবে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা বইয়ের বর্ণনা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ এই বইয়ে যেভাবে শারীরিক পরিবর্তন, মেয়েদের মাসিক ও ছেলেদের বীর্যপাত নিয়ে অনুসন্ধান করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে তাতে আমাদের একটি শালীন প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের সমাজে অবৈধ গর্ভপাতের যে পরিসংখ্যান তা হয়তো আগামীতে আরো অনেক গুণে বেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা আরো মনে করেন, সেক্সুয়াল এডুকেশনের জন্য বইপুস্তক নয়; বরং পরিবারই যথেষ্ট। ছেলেমেয়েদের এসব বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব স্কুল বা সরকারের নয়, এটা পরিবারের দায়িত্ব। তবে হ্যাঁ, প্রয়োজনে বাবা-মায়ের জন্য সরকারের তরফ থেকে আলাদা ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়াল দেয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং পিরোজপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি কাজী সাইফুদ্দীন নয়া দিগন্তকে জানান, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ে এসব সেক্সুয়াল বিষয় অন্তর্ভুক্ত না করলেই ভালো হতো। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। শিশুরা ক্লাসরুমে বা ক্লাসরুমের বাইরে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে সেগুলোর প্রতিফলন তাদের মনে এবং আচরণেও পড়বে। আর স্কুলের নিচের (মাধ্যমিকের) শ্রেণীর নতুন পাঠ্যবইয়ে এমন সেনসেটিভ বিষয় কেনইবা অন্তর্ভুক্ত করা হলো এটা আসলে আমার বোধগম্যও নয়। এগুলোর লেখকইবা কারা? তারা কেন এগুলো ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের বইয়ে (পাঠ্যসূচিতে) নিয়ে এলো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করীম গতকাল রোববার সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে জানান, দেশের শিক্ষানীতি হবে জাতিকে একটি সুন্দর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য।

অথচ বাংলাদেশে সহশিক্ষা চালু থাকায় এবং নতুন কারিকুলামে সেক্সুয়াল বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করায় ছেলেমেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমরা আমাদের পরিবার-সমাজ থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারি।
এখন যদি সব বিষয়ই বইয়ের পাতা থেকে শিখতে হয় তাহলে তো আর সমাজ বা পরিবার ব্যবস্থার কোনো দরকার নেই। তাই আমি মনে করি নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার পরিবর্তে অনৈতিক কাজের দিকেই বেশি ধাবিত করবে। মেধার বিকাশ না ঘটিয়ে আগামী প্রজন্মকে ক্রমেই মেধাহীন ও চরিত্রহীন করে তুলবে। কাজেই শ্রেণিকক্ষের সঠিক পাঠদানই পারে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/836351