২০ মে ২০২৪, সোমবার, ১০:৫০

মিরপুরে পুলিশ-অটোরিকশা চালকদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র ॥ ট্রাফিক বক্সে আগুন

রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্র হয়। কালশীতে ট্রাফিক পুলিশের বক্সে আগুন দিয়েছে আন্দোলনরত ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। এসময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে সাগর চৌকদার (২৫) নামে এক পথচারী গুলীবিদ্ধ হয়েছে। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। বিক্ষোভ চলাকালে কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এক পর্যায়ে বিকেলে সড়ক ছেড়ে চলে যান বিক্ষোভকারীরা। এর আগে সকাল থেকে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন। রিক্সা চালকদের আন্দোলনে এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।

সাগরকে হাসপাতালে নিয়ে আসা রাকিবুল ইসলাম জানান, তাদের বাসা মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন, বাউনিয়াবাদ এলাকায়। সেখানে একটি টেইলার্সে কাজ করেন সাগর। তারা দু’জন সকালে একটি কাজে উত্তরায় গিয়েছিলেন। বিকালে সেখান থেকে মিরপুরের বাসায় ফিরছিলেন। পথে কালশী মোড়ে এসে দেখেন পুলিশের সঙ্গে অটোরিকশা চালকদের একটি সংঘর্ষ হচ্ছে। অটোরিকশা চালকদের দমাতে পুলিশ সেখানে গুলী চালাচ্ছিল। তখন সেই সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গেলে সাগরের গলা ও বাম কাঁধে ৪-৫টি গুলী লাগে। এ সময় তিনি রাস্তায় পড়ে যান। পরে তাকে প্রথমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, সাগর নামে ওই যুবক গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তাকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

পুলিশ ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর গোলচত্বর এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন চালকেরা। বেলা তিনটা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান নেন তারা। এ সময় বিক্ষুব্ধ চালকেরা ৮-১০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশের ধাওয়ায় বিক্ষোভকারীরা মিরপুর গোলচত্বর এলাকা ছেড়ে কালশী মোড় এলাকায় অবস্থান নেন। বিকেল চারটার দিকে সেখানকার একটি পুলিশ বক্সে আগুন দেন তারা। এর ঘণ্টাখানেক পর সাড়ে পাঁচটার দিকে পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভাকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এর আগে দুপুর সোয়া একটার দিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা কালশী সড়ক আটকে দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। অনেকের হাতে লাঠি দেখা যায়। তারা গাড়ি ভাঙচুর করতেও উদ্যত হয়। তারা সড়কের মাঝখানে রশি টানিয়ে দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। এক পর্যায়ে সড়কে তারা গাড়ি আড়াআড়িভাবে রাখতে বাস চালকদের বাধ্য করেন। এতে ওই সড়ক ব্যবহারকারী হাজার হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন। গন্তব্যে যেতে মানুষজনকে পায়ে হেঁটে রওনা দিতে দেখা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় আসেন ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ইলিয়াস মোল্লা। তিনি আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন এবং অটোরিকশা চলাচলের বিষয়ে আলোচনার আশ্বাস দেন। তার আশ্বাসে চালকদের একটি অংশ আন্দোলন শেষ করে ফিরতে সম্মত হয়। তবে শেওড়াপাড়া থেকে আসা শ্রমিকদের একাংশ লাঠি হাতে হই-হুল্লোড় করে এসে আবারও অবরোধ শুরু করে। এসময় পুলিশ তাদের সরে যেতে বললে তারা পুলিশের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। শেওড়াপাড়া দিয়ে মিরপুরের দিকে আসা অটোরিকশা চালকদের একটি অংশ ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে এবং লাঠি নিয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশও পাল্টা ধাওয়া দেয়। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপরই মিরপুরের বিভিন্ন সড়ক দিয়ে থেমে থেমে যান চলাচল শুরু করে। বিক্ষোভের সময় মিরপুর গোল চত্বরে তিনটি বাস ভাঙচুর করেন অটোরিকশা চালকরা। এ সময় বাসে থাকা যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে বাস থেকে নেমে পড়েন।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, রাস্তায় অটোরিকশা চলতে দিচ্ছে না পুলিশ। কয়েক দিন ধরে মিরপুর এলাকায় অনেক চালককে আটক করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে অটোরিকশা। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, তাদের অনেক চালককে পুলিশ আটক করেছে। তাদের ছেড়ে দেওয়ার ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে দেওয়া পর্যন্ত অটোরিকশা চালানোর সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি। এই চালক আরও বলেন, সকালে কিস্তির টাকা নেওয়ার জন্য লোকজন এসে তার বাসায় বসে আছেন। অটোরিকশা বন্ধ থাকায় তার কোনো উপার্জন নেই। কীভাবে কিস্তির টাকা পরিশোধ করবেন, পরিবারের খরচ চালাবেন, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন, বলেন তিনি।

মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্ল্যা বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পর মিরপুর এলাকা থেকে অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে অটোরিকশা চালকরা মিরপুর-১০ গোলচত্বরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন এবং সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, পুলিশ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর স্থানীয় সংসদ সদস্যের (এমপি) উপস্থিতিতে মিরপুর-১০ নম্বর চত্বরে থাকা চালকদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মিরপুর-১০ নম্বর থেকে সরে তারা হয়তো কালশীতে গিয়ে রাস্তায় আগুন দিয়েছে। বেলা সাড়ে চারটার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর চত্বর থেকে অটোরিকশাচালকদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। এতে মিরপুর-১০ এলাকায় যানচলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সি সাব্বির আহমেদ বলেন, অটোরিকশার চালকেরা গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। অটোরিকশার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলছে। বেশ কিছু অটোরিকশা ও চালককে আটক করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছেন অটোরিকশাচালকেরা। পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেসুর রহমান বলেন, কালশীতে আন্দোলনকারীরা সহিংস আন্দোলন করছে। তারা কালশী মোড়ে অবস্থিত একটি পুলিশ বক্সে আগুন দিয়েছে। এটি ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্স। আমরা ঘটনাস্থলে আছি, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি।

উলেল্লখ্য, গত ১৫ মে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে না দেওয়ার নির্দেশ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন। সেতুমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো যাবে না। এ বিষয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়, এগুলো চলতে যেন না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ২২ মহাসড়কে রিকশা ও ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন। তিনি বলেছেন, ঢাকায় চলাচল করা লক্কড়-ঝক্কড় ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার।

বিআরটিএ’ র নির্দেশনা: ঢাকার সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান এবং এ ধরনের তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ। শনিবার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বিআরটিএ বলছে, ব্যাটারি বা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা এ জাতীয় থ্রি-হুইলার ঢাকা মহানগরীতে চলাচলের কারণে সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ব্যাটারি/রিকশা বা ভ্যান বা এ ধরনের থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ অবস্থায় ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারি/রিকশা বা ভ্যান বা এ ধরনের থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো বন্ধ করার অনুরোধ করা যাচ্ছে। নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে বিআরটিএ। এদিকে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি দিয়েছে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ। এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্মসূচির কথা জানায় সংগঠনটি।

https://www.dailysangram.info/post/556651