১৩ মে ২০২৪, সোমবার, ৮:৪৯

বাজারে আগাম অপরিপক্ব ফলে বিপদের শঙ্কা

মধুমাস বলে খ্যাত জ্যৈষ্ঠ মাস শুরুর এখনো কয়েক দিন বাকি থাকলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে আম লিচুসহ মৌসুমি ফল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভরা মৌসুম শুরুর আগেই বাজারে বিক্রি হওয়া এসব ফল অপরিপক্ব। বিক্রেতারা বেশি মুনাফা লাভের আশায় আগাম এসব ফল কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন। ফলে এসব যারা কিনছেন তাদের জন্য বড় বিপদের শঙ্কা রয়েছে। অপর দিকে ক্রেতাদের অভিযোগ বর্তমানে বাজারে বিক্রি হওয়া এসব ফল দেখে বোঝার উপায় নেই যে তা অপরিপক্ব। কিন্তু বাজার থেকে কেনা আম বাসায় গিয়ে কেটে দেখা যাচ্ছে তার আঁটিও শক্ত হয়নি। অথচ বাইরে পাকা রঙ। অন্য দিকে বাইরে লাল রঙ ধরা লিচু ছিলে মুখে দিতেই ভয়নক টক লাগছে। তাতেই প্রমাণিত সঠিক সময়ের আগে বাজারে আসা এসব ফল কৃত্রিমভাবে পাক ধরিয়ে ক্রেতা ঠকানো হচ্ছে।
গতকাল একাধিক বাজার ঘুরে দেখা যায় প্রতিটি বাজারেই লিচু গোপাল ভোগ ও গোবিন্দ ভোগ আম বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতাদের ভাষ্য, এখন আম ও লিচুর ভরা মওসুম। তাই তারা পরিপক্ব আম লিচু বিক্রি করছেন। বিক্রেতাদের এমন দাবি অসত্য জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্তৃপক্ষ বলছে, চলতি মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে বাজারে পরিপক্ব আম ও লিচু আসবে। কারণ মধ্য মে থেকেই গোপালভোগ আম ও লিচু পাকতে শুরু করে। এর আগে যেগুলো বাজারে আসছে তা পাকা নয়। পরিপক্ব বলে বিক্রি হওয়া এসব ফল খাবারের অযোগ্য। তাতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। কৃষিতথ্য সার্ভিস বলছে, কার্বাইড বিক্রিয়ায় পাকানো ফলটি ভেতরে বাইরে স্বাভাবিক পাকা ফলের মতো বর্ণ ধারণ করলেও এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়।

কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, মধ্য মে থেকে বাজারে দু’টি জাতের আম আসে। একটি গোপালভোগ অন্যটি গোবিন্দভোগ। গোপালভোগ সবার আগে পরিপক্ব হয়। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে পরিপক্বতা লাভ করতে শুরু করে। মে মাসের ২০ তারিখের পর থেকে পরিপক্ব আম বাজারে আসতে থাকে এবং জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এ আম আর পাওয়া যায় না। উৎকৃষ্ট ও পরিপক্ব গোপালভোগ আম কেনার উপযুক্ত সময় মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে জুন মাসের ১০ তারিখের মধ্যে। আর গোবিন্দভোগ আম মে মাসের মাঝামাঝি থেকে পাকতে শুরু করে। এই আম কেনার উপযুক্ত সময় ১৫ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত। ফালে পরিপক্ব আম খেতে চাইলে এই সময়টা মনে রাখতে হবে।

অন্য দিকে পরিপক্ব লিচুও মধ্য মে থেকে বাজারে আসে। এর আগে যেগুলো বাজারে আসে তা আগাম জাতের অপরিপক্ব অবস্থায় গাছ থেকে তোলা হয়। ফলে সেগুলোতে যেমন স্বাদ হয় না তেমনি কৃত্রিমভাবে পাকানোতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্রেতারা বলছেন, বাজারে ওঠা এসব আম, লিচু ল্যাবে পরীক্ষা করে বাজারে বিক্রির অনুমতি দেয়া উচিত। তাদের অভিযোগ, অপরিপক্ব ফল নিষিদ্ধ কার্বাইড, রাইপেন, ইথোফেনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হচ্ছে। আড়তগুলোতে এসব রাসায়নিক দিয়ে ফলের গায়ে স্প্রে করার কারণে অপরিপক্ব ফল হলুদ বর্ণ পায় এবং দৃশ্যত পেকে যায়।

আবার অপরিপক্ব লিচু বড় করার জন্য ব্যবহার করা হয় জোবাস, ম্যাগনল ও কোরবান নামের কেমিক্যাল। গাছ থেকে ঝড়ে পরা রোধ করতে ব্যবহার করা হয় সিনথেটিক পাইরয়েড। এ ছাড়া বেল্ট, রিপকট, ফ্লোরা, জিকোজেন, ডেসিস ব্যবহার করা হয় লিচুতে পোকার আক্রমণ যেন না হয় সেজন্য। এসব উপাদান মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। ফলে তা খেয়ে ক্রেতার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।

ফলে রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, চলতি মাসের ২০ তারিখের পর থেকে বাজারে পাকা আম ও লিচু নামার উপযুক্ত সময়। কিন্তু অতি মুনাফার লোভে কিছু ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাসায়নিক দিয়ে পাকানো অপরিপক্ব আম বাজারে বিক্রি করছেন।

তাদের মতে, মূলত ২০ মে থেকে আম ও ২১ মে থেকে লিচু গাছ থেকে নামানোর প্রকৃত সময়। গোপাল ভোগ জাতের আম গাছ থেকে নামানো শুরু হবে ২০ মে থেকে। আর সর্বশেষ গাছ থেকে গৌরমতি জাতের আম নামানো শুরু হবে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। এ ছাড়া খিরসাপাত ২৮ মে, ল্যাংড়া ৬ জুন, লক্ষণভোগ ১ জুন, ফজলি ও আ¤্রপলি ৩০ জুন থেকে গাছ থেকে পাড়া হবে। অপর দিকে চায়না-৩ জাতের লিচু নামানো শুরু হবে ২১ মে থেকে। কিন্তু রাজধানীর পাইকারি ফলের আড়ত, বাদামতলীর কিছু ব্যবসায়ীর পাশাপাশি কাওরান বাজার ও যাত্রাবাড়ীর কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী এই আম খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে এখন বিক্রি করছেন।

বিশিষ্ট চিকিৎসক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: আবুল কালাম আজাদ জানান, ফলে যে কার্বাইড দেয়া হয়, এটা খাবারের সাথে যুক্ত করার মতো কোনো রাসায়নিক নয়। ফলে এটি পুরোটাই ক্ষতিকর এবং ত্বক ও শ্বাসের অ্যালার্জি থেকে শুরু করে খাদ্য পরিপাকতন্ত্র, লিভার, কিডনি এসব অর্গানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

আর কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে ক্রেতাসাধারণ ও ভোক্তা প্রতারিত হয় এবং তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। তাদের মতে, কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষের দীর্ঘমেয়াদি নানা ধরনের রোগ, বিশেষ করে বদহজম, পেটেরব্যথা, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মতো জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া এর প্রভাবে নারীরা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারেন। কৃত্রিম উপায়ে পাকানো ফল শিশুদের ওপর বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/834596