১১ মে ২০২৪, শনিবার, ৫:৪৮

রাজধানী জুড়ে বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব

রাজধানী জুড়ে বিদ্যুতের অবৈধ লাইনের ছড়াছড়ি। বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় প্রতিদিন অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে হাজারো মানুষ। অথচ বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে দেশজুড়ে ভোগান্তি চরমে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছে জাতীয় সংসদেও। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চার্জ থেকে শুরু করে রাজধানীর ফুটপাথ দখল করে গড়ে ওঠা শত শত দোকান, বস্তিঘর, আবাসিক বাড়ির ছোট ছোট কারখানায় দেদারছে চলছে অবৈধ বিদ্যুৎ চুরির মহোৎসব। সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এভাবে মিটার ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে যেমন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছেন অনেকে, তেমনই রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সরজমিন হাজারীবাগ, রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গুলিস্তান, পোস্তগোলা, শ্যামপুর, জুরাইন, কাওরান বাজার, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

রাজধানীর রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী এলাকার একটি রিকশার গ্যারেজে গিয়ে দেখা যায়, মূল খুঁটির পাশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের দু’টি তার থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় সংযোগ নেয়া হয়েছে গ্যারেজটিতে। যেখানে প্রতিরাতে ২২টি রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হয়। গ্যারেজটির প্রবেশ মুখে একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। আছে বিদেশি কুকুরও।

গ্যারেজের মধ্যে একটি মিটার দৃশ্যমান থাকলেও তার সঙ্গে সঞ্চালন লাইনের কোনো সম্পর্ক নেই। যা দিয়ে চার্জ করা হচ্ছে একাধিক রিকশা। তবে গ্যারেজটির মালিক মো. রফিক মিয়া বলেন, তার রিকশাগুলো বৈধ লাইনেই চার্জ করা হয়।

এলাকাটিতে আরও বেশক’টি ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। সবক’টিতেই একই ভাবে তার টেনে লাইন নেয়া হয়েছে। কামরাঙ্গীরচর এলাকারও বেশির ভাগ রিকশা ব্যাটারিচালিত। এসব রিকশার ব্যাটারিতেও বিদ্যুতের খুঁটি ও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় নেয়া লাইন দিয়ে চার্জ করা হয়। ইশতিয়াক হোসেন নামে এলাকাটির এক বাসিন্দা বলেন, কামরাঙ্গীরচরে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। রহস্যজনক কারণে এসব গ্যারেজের সবক’টিতেই শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ করা হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে- এসব গ্যারেজের একটিতেও বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। গ্যারেজগুলোর মালিকরা স্থানীয় লাইনম্যানদের নির্দিষ্ট মাসোহারা দিয়ে এসব লাইন চালান। মো. আজগার নামে এক গ্যারেজমালিক বলেন, মূলত বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ব্যাটারি চার্জ করে রিকশা ভাড়া দিয়ে পোষায় না। যা জমা পাই তার বেশির ভাগই রিকশার রক্ষণাবেক্ষণে চলে যায়। যে কারণে প্রতিটি গ্যারেজেই অবৈধ লাইন দিয়ে ব্যাটারি চার্জ দিতে হয়। মুগদা এলাকাতেও বেশক’টি ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। এসব গ্যারেজেও ব্যাটারি চার্জ করা হয় অবৈধ লাইন দিয়ে। সোহেল রানা নামে এলাকাটির এক বাসিন্দা তার বাড়ির পাশের রিকশার গ্যারেজ দেখিয়ে বলেন, এই গ্যারেজটিতে প্রতিরাতে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয়। ওই রিকশার ব্যাটারিগুলো কোনো বৈধ মিটারের বিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ দেয়া হয় না। সরাসরি বিদ্যুতের খুঁটি থেকে সংযোগ নিয়ে রিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয়। বিষয়টি সকলেই জানে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্যুৎ অফিসের লোক জড়িত। এভাবেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, হাজারীবাগ, রায়েরবাগ, মানিকনগর, বাসাবো, মুগদা, খিলগাঁও, মান্ডা, নন্দীপাড়া, রামপুরা, ইসলামবাগ, পশ্চিম ধানমণ্ডি, সোয়ারীঘাট, বাবুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যারেজে হাজার হাজার অটোরিকশা প্রতিরাতে চার্জ করা হচ্ছে।

এদিকে বিদ্যুৎ চুরির আরেক মহাযজ্ঞ চলছে রাজধানীর ফুটপাথ ও রাস্তা দখল করে গড়ে ওঠা দোকানগুলোতে। প্রতিটি ফুটপাথে সন্ধ্যার পরে যে লাইটগুলো জ্বলে তার বেশির ভাগই অবৈধ সংযোগ। মিটার ছাড়া বিদ্যুতের খুঁটি থেকে লাইন নিয়ে দিন প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা দিয়েই একাধিক লাইট জ্বালাচ্ছেন দোকানিরা। চলছে ফ্যানও। নেই কোনো ইউনিটের গণনা। আর এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে বিশাল এক সিন্ডিকেট। রাজধানীর গুলিস্তানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গোলাপ শাহ্ মাজার, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, স্টেডিয়াম গেট এলাকায় ফুটপাথ জুড়ে গড়ে উঠেছে জামা-কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেল্ট, খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান। এমনকি এলাকাটির অনেক রাস্তা দখল করেও চলছে ব্যবসা। আর এসব শত শত ব্যবসায়ীর সকলেরই রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এর বেশির ভাগই অবৈধ। রবিউল নামে এক জুতা ব্যবসায়ী বলেন, আমরা এতসব বৈধ-অবৈধ বুঝি না। আমরা দিনপ্রতি ২০ টাকা দিয়ে দিই, ঝামেলা শেষ। এরপর একটা লাইট জ্বালাই আর ৫টা লাইট জ্বালাই তার হিসাব নেয় না কেউ। গরমের দিনে ফ্যানও চলে। তবে কে এই টাকা নেয় বা মিটার আছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি উত্তর দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমাদের কোনো মিটার নেই। প্রতিটি দোকানের উপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে ঝোলানো রয়েছে তাদের লাইট জ্বালানো হোল্ডার। কেউ আবার দিনের বেলায় তার গুটিয়ে রেখে দেন দোকানের পিছনে। শরিফ হোসেন নামে এক জামা-কাপড়ের দোকানি বলেন, আমাদের কোনো মিটার নেই।

শামীম নামে একজন এই বিদ্যুতের টাকা নেয়। প্রতিদিন টাকা দিয়ে দিই, সন্ধ্যা লাগতেই বিদ্যুৎ চলে আসে। তিনি বলেন, রাজধানীর একেক এলাকার ফুটপাথের লাইন একেক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করেন। মতিঝিল শাপলা চত্বর, সোনালী ব্যাংকের পেছনে, আলিকো ভবন থেকে মধুমিতা সিনেমা হল, দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ফকিরেরপুল, বিমান অফিসের আশপাশে, সড়ক ভবনের সামনে ও স্টেডিয়ামের গেটের দু’দিকে প্রতিদিন কয়েক হাজার দোকান বসে। এসব দোকানে সন্ধ্যা হলেই হাজার হাজার বাল্ব জ্বলে। ওই দোকানগুলোরও বৈদ্যুতিক সংযোগ আশপাশের মেইন লাইন থেকে নেয়া। তিনি বলেন, এই গুলিস্তান এলাকায় প্রায় তিন হাজার সংযোগ চালান নুরু, শামীম, আসাদ। তাদের মাসিক আয় কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা। এই অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে তারা এখন কোটিপতি। তাদের পক্ষ হয়েই কাজ করে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকার লাইনম্যানরা। খাজা গরিবে নেওয়াজসহ বিভিন্ন নামে তারা নামেমাত্র কয়েকটি মিটার দেখিয়ে মাস শেষে মাত্র কয়েক হাজার টাকা বিল বিদ্যুৎ অফিসে জমা দেন। এদিকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার সামাদ সুপার মার্কেট থেকে শহীদ ফারুক রোডের খানকাহ্ শরীফ মসজিদ পর্যন্ত রাস্তায় এই রমরমা অবৈধ কারবার। যার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় একটি শক্তিশালী চক্র। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ বিদ্যুৎ-সংযোগ দিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। এছাড়াও কাওরান বাজার, মিরপুর, ফার্মগেট, মহাখালী, গাউছিয়া, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথের দোকানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগেই চলছে কার্যক্রম।

অপরদিকে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, বংশাল, চকবাজার, শহীদ নগর, বউবাজার, সাতরওজা, সুরিটোল, পানিটোলা, ঝুলনবাড়ী, শাঁখারীবাজার, পাটুয়াটুলী, কোতোয়ালি, কামালবাগসহ বেশক’টি এলাকায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক কারখানা। আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা এসব কারখানার বেশির ভাগই বিদ্যুৎ সংযোগ অবৈধ। চানখাঁরপুল লেন রোডের বাসিন্দা আজগার আলী বলেন, অনেক বাড়ির মালিক তাদের আবাসিক বাড়িতে বিভিন্ন পণ্য তৈরির কারখানাকে ভাড়া দিয়েছেন। এসব অধিকাংশ কারখানায় গোপনে অথবা কৌশলে চোরাই লাইন ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছেন। তারা নিজেরাই মই বানিয়ে নিয়েছেন। বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের খুশি করে তারা ইচ্ছামতো যখন যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছেন। আর এসব অবৈধ লাইনের জন্য প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। সাতরওজা এলাকার বাসিন্দা ইমরান হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অভিনব কায়দায় আবাসিক এলাকায় যেনতেনভাবে কারখানা স্থাপনা করে বাইপাস লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার চলছে।

এই এলাকা থেকে বিদ্যুৎ অফিসের দূরত্ব বেশি না। তাদের অজানা কিছুই নেই। সবাই এর সঙ্গে জড়িত। মো. বসিরুদ্দিন নামে বংশাল এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে এই এলাকার অনেক বাসাবাড়ির মালিক তাদের বাসাবাড়িতে ছাপাখানা, লেদমেশিন, পলিথিন ও প্লাস্টিক কারখানা ভাড়া দিয়েছেন। তাদের অনেকেরই বিদ্যুৎ সংযোগ অবৈধ। তিনি বলেন, পুরো বংশাল এলাকায় কী পরিমাণ কলকারখানাগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন চলছে সেই হিসাব কারও জানা নেই। শুধু আমরা জানি, এসব অবৈধ লাইন। আর অবৈধ লাইন নেয়া হচ্ছে সরাসরি মেইন লাইন থেকে।

রাজধানীর বস্তিগুলোতেও দেদারছে চলছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি, রূপনগরের ঝিলপাড়ের বস্তি, কালশীর দুয়ারীপাড়া বস্তি, গুলশানের কড়াইল, বউবাজার ও জামাইবাজার, মহাখালীর সাততলা বস্তি, খিলগাঁও ঝিলপাড়, বাসাবোর ওহাব কলোনি, মগবাজারের মধুবাগ ঝিলপাড়, শান্তিবাগ রেললাইন, মালিবাগ, মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী, বউবাজার, হাজারীবাগসহ এমন কোনো বস্তি নেই যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। এসব বস্তিগুলোর প্রতিটি ঘরেই রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। যার বেশির ভাগই অবৈধ। প্রধান সড়কের সঞ্চালন লাইন থেকে তার টেনে দেয়া হয়েছে এসব সংযোগ।

এসব বিদ্যুৎ লাইনের নেই কোনো মিটার। ইচ্ছামতো বাতি, বৈদ্যুতিক চুলা, টিভি-ফ্রিজ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে কারা এসব লাইন দিয়েছে, কারা নিয়ন্ত্রণ করছে- সে বিষয়ে মুখ খুলতে চান না বস্তির কেউ। রহিমা নামে চলন্তিকা বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, আমি কারও নাম বলতে পারবো না। তবে আমি যে বাড়িতে থাকি, আমি বাসা ভাড়া দেই। এখানে বিদ্যুৎ বিল নেয় না। ভাড়ার সঙ্গেই সব। কোনো মিটার নেই। আক্তার হোসেন নামে মিরপুর রূপনগর এলাকার বাসিন্দা বলেন, গত বছরও আমাদের এখানকার বস্তির অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য চারজন বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। এরপরও কিছুই বদলায়নি। কয়েকদিন আগে অভিযান চললেও পরক্ষণেই সবই আগের মতোই চলে। চায়ের দোকান, বাসা বাড়ি সব জায়গাতেই দেদারছে চলছে অবৈধ সংযোগ।

এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউএম শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ আসছে- ফুটপাথের দোকানগুলোতে নামেমাত্র মিটার দেখিয়ে অবৈধ সংযোগ দিয়ে কিছু অসাধু চক্র ব্যবসা করে আসছে। অনেকে আবার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে হুক বাঁধিয়ে অবৈধ লাইন নিয়ে রিকশার ব্যাটারি চার্জ করছে। আমরা নিজেরাও এসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তারপরও এদের থামানো যাচ্ছে না। আমরা এ বিষয়ে আরও যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।

https://mzamin.com/news.php?news=109337