দিন দিন ভোটের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে এখন আর সায় দিচ্ছে না ভোটাররা। সরকারি দল নানা কৌশল অবলম্বন করেও ভোট কেন্দ্রে মানুষ নিতে পারছেনা। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে গত দেড় দশকের মধ্যে ভোটের হার সর্বনিম্ন। মানুষ কেন ভোটের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে তা নিয়ে চলছে নানা রকমের বিশ্লেষণ।
মানুষ যাতে ভোট কেন্দ্রে আসে সেজন্য এবার প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল সরকারি দল। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করে প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের দেয়া প্রতীকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মুখে দলীয় প্রতীক না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছিল আওয়ামী লীগ। তবুও ভোটারদের উপস্থিতির হার বেশি ছিল না।
জানা গেছে, বিগত তিনটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবে এবার ভোটের হার সবচেয়ে নিচে নেমেছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ৮১টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে।
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ বুধবার ভোট শেষ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন ভবনে বলেছিলেন, অনেক ভোটার ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় ভোটকেন্দ্রে আসেননি। ভোটার বেশি এলে নির্বাচন আরও ভালো হতো।
জানা গেছে, ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। আর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবার প্রথম ধাপে ভোটের হার ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পরপর চারটি উপজেলা নির্বাচনে ভোট কমেছে ধারবাহিকভাবে। এবার ভোটের হার সর্বনিম্ন ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন , জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচন সব ধরনের ভোটেই মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর প্রতিফলন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলায়ও দেখা যাচ্ছে। ভোটারের অনীহার বিষয়টি এখন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও অনেকে স্বীকার করেন। এর কারণ কী এবং দায় কার এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না এবং উপজেলা নির্বাচনও হয়নি সেটিই ভোটারদের নির্বাচনবিমুখ করার অন্যতম একটি কারণ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই তা মনে করছে।
অন্যদিকে বিএনপি দায় দিচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ওপর। দলটি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছে। এই দাবিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করেছে। যদিও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে দলটির কিছু নেতা অংশ নিয়েছেন। বিএনপির নেতারা বলছেন, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন নিয়ে মানুষের অনাস্থার বিষয়টি কাজ করেছে।
তবে বিএনপি নেতাদের এসব কথা মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের । তিনি গতকাল শুক্রবার বলেছেন, বিএনপি ভোটারদের ভয় পায়, তাই নির্বাচনে আসে না। এই ভয় থেকে নির্বাচন বয়কট করে। এর আগে যদিও ভোটের এই হার নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বুধবার সাংবাদিক সম্মেলন তিনি বলেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে এ বিষয়টিকেই তারা গুরুত্ব দিতে চাইছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রতিফলন এই ভোটের ফলাফল। আর এই অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার কম হওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। এমন পটভূমিতে উপজেলায় ভোটের হার আরও কম পড়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনীহার বিষয়টি নতুন করে উঠে আসলো।
নৌকা প্রতীক’ না দেয়ার পেছনে উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করাও অন্যতম লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি। প্রথম ধাপের ৬৩টি উপজেলায় তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। এসব উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটের ব্যবধান ১০ হাজারের বেশি। মাত্র ১৩টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে বেশি। এই উপজেলাগুলোতে ব্যবধান ১ হাজার ভোটের কম। ৩১টি উপজেলায় ভোটের ব্যবধান হয়েছে ৩ হাজারের কম।
নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের অনাস্থাকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মানুষ শঙ্কায় থাকেন ভোট দিতে যেতে পারবেন কি না; গেলেও পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারবেন কি না; ভোট দিলেও সেটা গণনা হবে কি না। এ অনাস্থার কারণে মানুষ এখন ভোটবিমুখ’।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনের নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। মোটা দাগে পাঁচ কারণে ভোট কম পড়েছে। ধান কাটার মৌসুম বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে ব্যুরো ধান যেসব এলাকায় আছে, এটা আমাদের আগেই মাঠ প্রশাসন থেকে বলেছে যে, ধান কাটার মৌসুমের জন্য ভোট কম পড়তে পারে। এ ছাড়া ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। আবার একটি বড় দল রাজনৈতিকভাবে অংশ না নেয়ায় ভোট কম হয়েছে।
