৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২:৫৯

জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে এবারও মুক্তি মিলছে না

১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিন মেগাপ্রকল্পের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী

চলতি মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখীর টানা এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ডুবে গেছে। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে গত সোমবার বিকেলের ওই বৃষ্টিতে নগরীর অনেক সড়ক ও এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে এবারও বর্ষা মৌসুম ঘিরে নগরবাসীর মধ্যে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বড় তিনটি প্রকল্পের কাজ বর্তমানে চলমান আছে।
কয়েক বছর ধরে এসব মেগাপ্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর। এক ঘণ্টার ভারি বর্ষণেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় এবারও বর্ষা মৌসুমে নগরীর অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে এই তিন মেগাপ্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে কিংবা জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে নগরবাসী কিভাবে মুক্তি পাবে, তা নিয়ে প্রকল্প সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার বর্ষায়ও নগরবাসী চার মেগাপ্রকল্পের সুফল পাবে না।
জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ এবারও পোহাতে হবে।
এদিকে প্রকল্পের কাজ নিয়ে একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর ফলে নগরবাসীর মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত এপ্রিলের আগে খাল-নালাগুলো পরিষ্কার করতে আমরা দাবি জানিয়েছিলাম। এপ্রিলের পর এখনো বেশি মাত্রায় বৃষ্টি হয়নি।

তবে গত সোমবারের বৃষ্টিতে অনেক সড়ক ও এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। খাল-নালা-নর্দমা দিয়ে পানি না নামায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পগুলোর কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলমান। কিন্তু শেষ না হওয়ায় নগরবাসী সুফল পাচ্ছে না।’

সাত বছরে জলাবদ্ধতার মূল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৬৩ শতাংশ
‘চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। কাজ শুরুর পর কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে বর্তমানে আট হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। সেই হিসাবে গত ছয় বছর ১১ মাসে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৬৩ শতাংশ।

সামনের বর্ষায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এই প্রকল্পের কাজ ১০০ শতাংশ শেষ হলে নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া জলাবদ্ধতার অন্য প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না হলে সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। নগরীতে এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার ড্রেন আছে। কিন্তু আমাদের প্রকল্পের আওতায় আছে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার। নগরীতে ৫৭টি খাল আছে। এর মধ্যে আমাদের প্রকল্পের অধীনে আছে ৩৬টি। তবে গতবারের মতো এবার জলাবদ্ধতা হবে না। আমাদের প্রকল্প কাজের কারণে অন্তত ৪০ শতাংশ এলাকায় এবার জলাবদ্ধতা হবে না।’

কালুরঘাট থেকে চাক্তাই সড়ক প্রকল্পের কাজ এখনো ৩০ শতাংশ বাকি
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল দুই হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়। এদিকে এক বছর আট মাস আগে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৪৩৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় বার সংশোধিতসহ বর্তমানে প্রকল্পটিতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। এর মধ্যেই কয়েক দফায় সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থা সিডিএ সূত্র জানায়, গত মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৭০ শতাংশ।

জলাবদ্ধতা নিরসনে এখনো সুফল না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ও সিডিএ নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শহরের ভেতরে জলাবদ্ধতার সঙ্গে আমাদের চলমান প্রকল্পের কোনো সামঞ্জস্য নেই। নালা-নর্দমা পরিষ্কার থাকলে বৃষ্টির পানি নালা হয়ে খাল দিয়ে নদীতে যাবে। কিন্তু আমাদের এই প্রকল্পের মাধ্যমে জোয়ারের পানি নদী থেকে যাতে শহরে ঢুকতে না পারে, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ১২টি জলকপাটের মধ্যে ১০টির কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে চাক্তাই, রাজাখালী ও নোয়াখালের মুখে তিনটি জলকপাটের পাম্প চালু হবে। প্রকল্পটির সময়সীমা আরো এক বছর বাড়ানো হবে।’

১০ বছরেও শেষ হয়নি ২.৯ কিমি, নতুন খাল খনন
নগরীর প্রধান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুরসহ আশপাশের সড়ক এলাকায় সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা দূর করতে ২০১৪ সালের ২৪ জুন ৩২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত দুই কিলোমিটার নতুন খাল খনন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। এরপর প্রথম সংশোধিত আকারে প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদন হয়। ওই সময় এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল চসিকের আট বছর আগের ৩২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প একনেকে দ্বিতীয় দফায় ব্যয় বাড়িয়ে এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। এদিকে ব্যয়ের সঙ্গে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এখনো প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে পারেনি চসিক।

এই ব্যাপারে চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ ফরহাদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২.৯ কিলোমিটার নতুন খাল খনন প্রকল্পের অগ্রগতি এখন ৭০ শতাংশ। সময় আরো এক বছর বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্পের অধীনে খালের উভয় দিকে রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। আর খালের খননকাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নগরবাসী সুফল পাবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/05/08/1385895