২০ মে ২০১৭, শনিবার, ৯:৫১

চট্টগ্রামে খাল দখলেই পানিবদ্ধতা

২২ খাল ভরাট দখল করে ৮৬০টি অবৈধ স্থাপনা : অসংখ্য নালা নর্দমা বেদখল : ভূমিদস্যুরা বেপরোয়া আরএস সিএস পিএস জরিপমূলে খাল-ছরাগুলো উদ্ধার এবং দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা দাবি

 উঁচুনিচু পাহাড় টিলা, উপত্যকা, বঙ্গোপসাগর, বন-জঙ্গল, নদী-খাল-‘ছরা’ ঝরণা, হ্র্রদে ঘেরা চট্টগ্রাম। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত ১২০ বর্গমাইল আয়তনবিশিষ্ট বন্দরনগরীর আছে বেশকিছু অপূর্ব ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। চট্টগ্রামকে বলা হয় প্রাচ্যের রানী। অনেক দেশে বিরল বৈশিষ্ট্যের এলাকাকে টিকিয়ে রাখার তাগিদ থেকে ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল)’ ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তার তাগিদ নেই উদ্যোগও নেই। প্রাচীনকাল থেকেই অনেকগুলো খাল ও ‘ছরা’ এই নগরীতে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি খাল ছরা চট্টগ্রামের শিরা-উপশিরা। কিন্তু নগরীর কোনো একটি খালও এখন আর ভালো নেই। দখলবাজি, ভরাট ও দূষণে প্রাণপ্রবাহ খাল যাচ্ছে হারিয়ে। অবৈধ দখলবাজদের কবলে পড়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১২টি খাল গায়েব হয়ে গেছে। প্রধান চাক্তাই খালসহ ২২টি খালের জায়গা বেদখল হয়েছে। সেগুলোতে ৮৬০টি বাড়িঘর, দোকানপাট, গুদাম-আড়ত, ঝুপড়িসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তাছাড়া নগরীর খাল ছরা, নালা-নর্দমাগুলো পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। সর্বত্র বেদখলে চলে গেছে অসংখ্য নালা-নর্দমা। অথচ অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান বা আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এর ফলে বেআইনি কর্মকাÐ চালিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে খাল ছরা নালা-খেকো খাল ছরা নালা-খেকো ভূমিদস্যুরা। দিনে দিনে হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। চট্টগ্রামের ভারসাম্য রক্ষাকারী খাল ছরা অবৈধ দখলের কারণে যখন বৃষ্টি হয় এবং কর্ণফুলী নদী ও সাগরের জোয়ারের সময় পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতে করে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর বড় অংশজুড়েই হচ্ছে ঘন ঘন ও মারাত্মক পানিবদ্ধতা। যা বছর বছর ক্রনিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলের পাশাপাশি ভরাট খালগুলো পুনঃখননের নামে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা পকেটে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের। সরেজমিনে অনুসন্ধান, দেশি ও বিদেশি সংস্থার জরিপ এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ সূত্রেই চট্টগ্রামে খাল-ছরা দখলের উপরোক্ত চালচিত্র বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে খাল ছরা দখলের পরিণতিতে স্থায়ী পানিবদ্ধতা সম্পর্কে সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আলী আশরাফ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রথম ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান জনসস্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের (পিএইচই) অর্থায়নে কয়েক বছর ধরে বন্দরনগরীতে ৫০টিরও বেশি খালের উপর জরিপ চালায়। এরমধ্যে শহরের দক্ষিণে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে পূর্বে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ৩৪টি খালের সরেজমিন ম্যাপ তৈরি করে। এতে খালগুলোর গতিপথের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য, তথ্য-উপাত্ত (প্রটোকল) বর্ণিত রয়েছে। অধ্যাপক আশরাফ আরও জানান, চলতি ২০১৭ সালে নতুন করে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরির জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার নিয়োজিত নেদারল্যান্ডসের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ চালায়। ১৯৬৯ সালের সেই একই জায়গায় পরিচালিত জরিপে আগের ৩৪টি খালের মধ্যে এবার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে ২২টির। অবশিষ্ট ১২টি খাল গায়েব হয়ে গেছে ! অথচ আরএস, সিএস, পিএস ভূমি-জরিপ রেকর্ড খতিয়ানে ৩৪ খালই আছে। তাছাড়া কোনোমতে টিকে থাকা ২২ খালের ভেতরে ১৩৯টি বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্থাপনা পাওয়া যায় উক্ত জরিপে।
৪৭ বছরের ব্যবধানে নগরীর ১২টি খাল কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেল এই প্রশ্ন রেখে এই নগরায়ন বিশেষজ্ঞ বলেন, চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা সঙ্কটের পেছনে খাল-ছরাগুলো অবৈধ দখল ও স্থাপনা নির্মাণ, দখলের উদ্দেশ্যে ভরাট অনেকাংশে দায়ী। নগরীর প্রধান চাক্তাই খালের সাথে সংযুক্ত ১০-১২টি উপখাল, ছরা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সেগুলো ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। আরএস, সিএস, পিএস রেকর্ড খতিয়ান মূলে অবিলম্বে খালগুলোকে খালের জায়গায় ফেরত আনা হোক। দখলকারীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিচারিক ব্যবস্থা নিতে হবেÑ এটাই এখন ভূক্তভোগী চট্টগ্রামবাসীর সম্মিলিত দাবি।
খাল দখলের হালচাল
১৯৬৯ সালে জনসস্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি জরিপে অর্ধশতাধিক খালের হিসাব থাকলেও চার যুগের ব্যবধানে বর্তমানে সবমিলিয়ে মহানগরীতে খালের সংখ্যা ৩৭টি। তাও কাগজে-কলমে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের ‘দুঃখ’ চাক্তাই খালসহ ১৬টি প্রধান খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। প্রধান ১৬টি খাল থেকে বের হয়েছে আরও কিছু শাখা ও উপখাল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছোট বড় মিলিয়ে ২২টি খালে বাড়িঘর, দোকানপাট, গুদাম, আড়তসহ অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ৮শ’ ৬০টি। এরমধ্যে আছে ৫০টিরও বেশি বহুতল ভবন, পাকা-আধাপাকা ও সেমিপাকা বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। চাক্তাই, কলাবাগিচা, হিজড়া, মির্জা, বির্জা, মহেশ, মরিয়মবিবি, মধ্যম-বদর, জামালখান সাবএরিয়া খাল-ছরায় দখল ও ভরাট সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া মহানগরীজুড়ে নালা-নর্দমা ভরাট করে দখলে নেয়া হয়েছে অসংখ্য। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। সেই সুবাদে নগরীর অনেকগুলো খাল ও ছরা ভরাট করে দখল চালিয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। এদের বিরুদ্ধে নিকট অতীতে আইনানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
দুর্ভোগে নগরবাসী, ব্যবসায় ক্ষতি
নগরীতে নির্বিচারে খাল ছরা, নালা-নর্দমা ভরাট ও দখলের কারনে স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের পথ অনেকটাই বন্ধ। আসন্ন বর্ষায় পানিবদ্ধতার সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এ নিয়ে সর্বস্তরের নগরবাসীর উদ্বেগ সীমাহীন। বর্ষার আগে গত চৈত্র ও বৈশাখ মাসের হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার ভারী বর্ষণে তিন দফায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে নগরীর বিশাল এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। এমনকি নগরীর কেন্দ্রস্থলে কিছুটা উঁচু এলাকা ষোলশহর, নাসিরাবাদ এবার কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। যা অনেককেই বিস্মিত করে তুলেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই চট্টগ্রাম বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পানিবদ্ধতা বেশি হয় এমন এলাকাগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার উৎপাদনে ইতোমধ্যে মন্দার ছায়া পড়েছে। পানিবদ্ধতার চরম দুর্ভোগে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বড় অংশ প্রায় অচল হয়ে পড়ছে। বৃষ্টির সাথে জোয়ার হলেই মহেশখাল দিয়ে পানি নামতে না পেরে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে পানিবদ্ধতা। আগ্রাবাদে পানিবদ্ধতা নিরসনে বন্দর কর্তৃপক্ষ এক বছর আগে মহেশখালের উপর বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু খালের বেদখল উচ্ছেদ ও ড্রেজিং না হওয়ায় সমস্যার সুরাহা হয়নি। এছাড়া দখলবাজির জেরে বিভিন্ন খাল-ছরা-নালার পথ অবরুদ্ধ হওয়ায় নগরীর বাকলিয়া, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট, শোলকবহর, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, রাজাখালী, সাগরিকা, হালিশহর, কাট্টলী, পতেঙ্গা ডুবে যায়।
দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার ‘সওদাগরী পাড়া’ খ্যাত চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, রাজাখালীর ব্যবসায়ীরা ভূগছেন পানিবদ্ধতার আতঙ্কে। প্রতিবছর এখানে কয়েক দফা পানিবদ্ধতায় কোটি কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়। বৃষ্টি ও জোয়ারে তলিয়ে যায় খাতুনগঞ্জ। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ চাক্তাই খাল উপচে বিরাট এলাকা প্লাবিত হয়। ডুবে যায় নিত্যপণ্য-ভর্তি শত শত দোকানপাট, গুদাম ও আড়ত। দখল, ভরাট ও দূষণে চাক্তাই খাল কর্ণফুলীর মোহনা পর্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। কমেছে খালের পানি ধারণ ও নিষ্কাষণের ক্ষমতা। অথচ আগে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছাদগঞ্জ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল খরিদ করে মফস্বলের ব্যবসায়ীরা চাক্তাই খালের উপর দিয়ে প্রতিদিন শত শত নৌকাযোগে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যেতেন। চাক্তাই খাল সেই নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। খাল পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে।
ভূমিদস্যুরা। দিনে দিনে হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। চট্টগ্রামের ভারসাম্য রক্ষাকারী খাল ছরা অবৈধ দখলের কারণে যখন বৃষ্টি হয় এবং কর্ণফুলী নদী ও সাগরের জোয়ারের সময় পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতে করে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর বড় অংশজুড়েই হচ্ছে ঘন ঘন ও মারাত্মক পানিবদ্ধতা। যা বছর বছর ক্রনিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলের পাশাপাশি ভরাট খালগুলো পুনঃখননের নামে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা পকেটে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের। সরেজমিনে অনুসন্ধান, দেশি ও বিদেশি সংস্থার জরিপ এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ সূত্রেই চট্টগ্রামে খাল-ছরা দখলের উপরোক্ত চালচিত্র বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে খাল ছরা দখলের পরিণতিতে স্থায়ী পানিবদ্ধতা সম্পর্কে সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আলী আশরাফ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রথম ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান জনসস্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের (পিএইচই) অর্থায়নে কয়েক বছর ধরে বন্দরনগরীতে ৫০টিরও বেশি খালের উপর জরিপ চালায়। এরমধ্যে শহরের দক্ষিণে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে পূর্বে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ৩৪টি খালের সরেজমিন ম্যাপ তৈরি করে। এতে খালগুলোর গতিপথের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য, তথ্য-উপাত্ত (প্রটোকল) বর্ণিত রয়েছে। অধ্যাপক আশরাফ আরও জানান, চলতি ২০১৭ সালে নতুন করে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরির জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার নিয়োজিত নেদারল্যান্ডসের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ চালায়। ১৯৬৯ সালের সেই একই জায়গায় পরিচালিত জরিপে আগের ৩৪টি খালের মধ্যে এবার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে ২২টির। অবশিষ্ট ১২টি খাল গায়েব হয়ে গেছে ! অথচ আরএস, সিএস, পিএস ভূমি-জরিপ রেকর্ড খতিয়ানে ৩৪ খালই আছে। তাছাড়া কোনোমতে টিকে থাকা ২২ খালের ভেতরে ১৩৯টি বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্থাপনা পাওয়া যায় উক্ত জরিপে।
৪৭ বছরের ব্যবধানে নগরীর ১২টি খাল কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেল এই প্রশ্ন রেখে এই নগরায়ন বিশেষজ্ঞ বলেন, চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা সঙ্কটের পেছনে খাল-ছরাগুলো অবৈধ দখল ও স্থাপনা নির্মাণ, দখলের উদ্দেশ্যে ভরাট অনেকাংশে দায়ী। নগরীর প্রধান চাক্তাই খালের সাথে সংযুক্ত ১০-১২টি উপখাল, ছরা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সেগুলো ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। আরএস, সিএস, পিএস রেকর্ড খতিয়ান মূলে অবিলম্বে খালগুলোকে খালের জায়গায় ফেরত আনা হোক। দখলকারীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিচারিক ব্যবস্থা নিতে হবেÑ এটাই এখন ভূক্তভোগী চট্টগ্রামবাসীর সম্মিলিত দাবি।
খাল দখলের হালচাল
১৯৬৯ সালে জনসস্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি জরিপে অর্ধশতাধিক খালের হিসাব থাকলেও চার যুগের ব্যবধানে বর্তমানে সবমিলিয়ে মহানগরীতে খালের সংখ্যা ৩৭টি। তাও কাগজে-কলমে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের ‘দুঃখ’ চাক্তাই খালসহ ১৬টি প্রধান খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। প্রধান ১৬টি খাল থেকে বের হয়েছে আরও কিছু শাখা ও উপখাল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছোট বড় মিলিয়ে ২২টি খালে বাড়িঘর, দোকানপাট, গুদাম, আড়তসহ অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ৮শ’ ৬০টি। এরমধ্যে আছে ৫০টিরও বেশি বহুতল ভবন, পাকা-আধাপাকা ও সেমিপাকা বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। চাক্তাই, কলাবাগিচা, হিজড়া, মির্জা, বির্জা, মহেশ, মরিয়মবিবি, মধ্যম-বদর, জামালখান সাবএরিয়া খাল-ছরায় দখল ও ভরাট সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া মহানগরীজুড়ে নালা-নর্দমা ভরাট করে দখলে নেয়া হয়েছে অসংখ্য। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। সেই সুবাদে নগরীর অনেকগুলো খাল ও ছরা ভরাট করে দখল চালিয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। এদের বিরুদ্ধে নিকট অতীতে আইনানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
দুর্ভোগে নগরবাসী, ব্যবসায় ক্ষতি
নগরীতে নির্বিচারে খাল ছরা, নালা-নর্দমা ভরাট ও দখলের কারনে স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের পথ অনেকটাই বন্ধ। আসন্ন বর্ষায় পানিবদ্ধতার সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এ নিয়ে সর্বস্তরের নগরবাসীর উদ্বেগ সীমাহীন। বর্ষার আগে গত চৈত্র ও বৈশাখ মাসের হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার ভারী বর্ষণে তিন দফায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে নগরীর বিশাল এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। এমনকি নগরীর কেন্দ্রস্থলে কিছুটা উঁচু এলাকা ষোলশহর, নাসিরাবাদ এবার কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। যা অনেককেই বিস্মিত করে তুলেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই চট্টগ্রাম বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পানিবদ্ধতা বেশি হয় এমন এলাকাগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার উৎপাদনে ইতোমধ্যে মন্দার ছায়া পড়েছে। পানিবদ্ধতার চরম দুর্ভোগে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বড় অংশ প্রায় অচল হয়ে পড়ছে। বৃষ্টির সাথে জোয়ার হলেই মহেশখাল দিয়ে পানি নামতে না পেরে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে পানিবদ্ধতা। আগ্রাবাদে পানিবদ্ধতা নিরসনে বন্দর কর্তৃপক্ষ এক বছর আগে মহেশখালের উপর বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু খালের বেদখল উচ্ছেদ ও ড্রেজিং না হওয়ায় সমস্যার সুরাহা হয়নি। এছাড়া দখলবাজির জেরে বিভিন্ন খাল-ছরা-নালার পথ অবরুদ্ধ হওয়ায় নগরীর বাকলিয়া, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট, শোলকবহর, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, রাজাখালী, সাগরিকা, হালিশহর, কাট্টলী, পতেঙ্গা ডুবে যায়।
দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার ‘সওদাগরী পাড়া’ খ্যাত চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, রাজাখালীর ব্যবসায়ীরা ভূগছেন পানিবদ্ধতার আতঙ্কে। প্রতিবছর এখানে কয়েক দফা পানিবদ্ধতায় কোটি কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়। বৃষ্টি ও জোয়ারে তলিয়ে যায় খাতুনগঞ্জ। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ চাক্তাই খাল উপচে বিরাট এলাকা প্লাবিত হয়। ডুবে যায় নিত্যপণ্য-ভর্তি শত শত দোকানপাট, গুদাম ও আড়ত। দখল, ভরাট ও দূষণে চাক্তাই খাল কর্ণফুলীর মোহনা পর্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। কমেছে খালের পানি ধারণ ও নিষ্কাষণের ক্ষমতা। অথচ আগে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছাদগঞ্জ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল খরিদ করে মফস্বলের ব্যবসায়ীরা চাক্তাই খালের উপর দিয়ে প্রতিদিন শত শত নৌকাযোগে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যেতেন। চাক্তাই খাল সেই নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। খাল পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে।

https://www.dailyinqilab.com/article/80181/