২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:১২

তীব্র গরমে বিপর্যস্ত অবস্থা অব্যাহত

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গরমের তীব্রতা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহে গরম আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় তিন দিনের জন্য হিট অ্যালার্ট দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। আর রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। একইসাথে আগামী তিন দিনের মধ্যে তেমন বৃষ্টির সম্ভাবনাও দেখছেন না আবহাওয়াবিদেরা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কিছ্টুা বৃষ্টি হলেও তাতে তাপ খুব একটা কমেনি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবীর গতকাল সন্ধ্যায় জানান, এই গরমে মানুষের অস্বস্তি বেশি হওয়ার কারণ, এখন বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প আছে। এর ফলে প্রচুর ঘাম হয়। তাতে মানুষ ক্লান্ত হয় এবং শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তরিফুল নেওয়াজ কবীর বলেন, আগামী তিন দিন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা কম। এ সময় কমা-বাড়ার মধ্যেই থাকতে পারে।

এদিকে তীব্র গরমে খেটে খাওয়া মানুষেরা পড়েছেন চরম ভোগান্তি ও ঝুঁকিতে। কর্মজীবীদের দুর্ভোগ বেড়েছে অন্য সবার চেয়ে বেশি। গরমে যেসব রোগ দেখা দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো- ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, জ্বর-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, পানিশূন্যতা, হিট স্ট্রোক ইত্যাদি। এ পরিস্থিতিতে একটু অসতর্কতায় ঘটতে পারে বিপদ।

তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ঢাকার সিভিল সার্জন কয়েকদিন আগেই দুপুর ১২ থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিনা কারণে বাসার বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশনা জারি করেছেন।

চিকিৎসকেরা বলছেন, এমন তীব্র গরমে অসুস্থ হওয়া স্বাভাবিক, তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এ গরমেও নিরাপদ থাকা যায়, ভালো থাকা যায়। বাইরে বের হলে বা রোদে গেলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রচুর পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন ও তরল খাবার খেতে হবে। তেল-মশলাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
শরীরের কোনো অংশে সরাসরি দীর্ঘক্ষণ রোদ লাগানো যাবে না। বাইরে বের হওয়ার সময় ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে, সানগ্লাস ও ছাতা, মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করতে হবে। রাস্তার খোলা খাবার পানি বা শরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কোথাও যাওয়ার আগে সঙ্গে অবশ্যই নিরাপদ পানি নিতে হবে।

বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলীর উপদেশ এ গরমে যারা সরাসরি সূর্যের আলোতে কাজ করেন, তাদের প্রচুর ঘাম হয়, ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। শরীর থেকে পানি ও লবণ কমে গেলে পানিশূন্যতা বা ডি-হাইড্রেশন হয়। তিনি বলেন, শরীর থেকে পানি ও লবণ কমে গেলে মানুষ শকে চলে যেতে পারেন, ব্লাড প্রেশার কমে যেতে পারে, মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, কিডনি অচল, ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হয়ে যেতে পারে। তীব্র গরমে শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

গরমে সুস্থ থাকতে করণীয় সম্পর্কে এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলেন, এ সময়ে অনেক পানি পান করতে হবে, সঙ্গে ফলের জুস খাওয়া যেতে পারে। সহজে হজমযোগ্য তরল খাবার খেতে হবে। প্রচুর ঘাম হলে স্যালাইন বা হালকা লবণ মিশ্রিত পানি পান করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, শ্রমিক, বিশেষ করে যাদের বাইরে কাজ করতে হয়, তারা যেন ছাতা ব্যবহার করেন। ছাতা না হলেও অন্তত মাথায় ক্যাপ কিংবা কাপড় ব্যবহার করতে হবে। কাজের মধ্যে কিছুক্ষণ পরপর অন্তত কয়েক মিনিট ছায়াযুক্ত জায়গায় বিশ্রাম নিতে হবে। সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, টানা কেউ যেন বেশি সময় রোদে কাজ না করেন।

রোগীদের হাঁসফাঁস অবস্থা : গরমের তীব্রতায় ছোট-বড় সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীরা। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সিলিং ফ্যান চললেও গরমে যন্ত্রণা কমছে না। ফ্যানের বাতাস মেঝে ও শয্যায় থাকা রোগী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে রোগীদের একমাত্র ভরসা নিজেদের কেনা টেবিল ফ্যান ও হাতপাখা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবন ও পুরাতন ভবনের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে এমন চিত্রই দেখা যায়। রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, গরমে টেকা যাচ্ছে না। ওয়ার্ডের ভেতরে মনে হয় চুলা জ্বলছে। শরীর তাপে পুড়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ডের সিলিং ফ্যান শুধু ঘুরছেই। বাতাস শরীরে লাগছে না। তারা জানান, সিলিং ফ্যানের বাতাস রোগী পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই তাদের সবার ভরসা বাইরে থেকে কিনে আনা টেবিল ফ্যান ও হাতপাখা। টেবিল ফ্যানের সংযোগ পেতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী জামাল উদ্দিন। পুরাতন ভবনের ঢাল সিঁড়িতে ওঠার পাশেই মেঝেতে তাকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। তীব্র গরমে প্লাস্টিকের হাতপাখা দিয়ে টানা বাতাস করে যাচ্ছেন তার মা ও ভাই। মা ডালিয়া বেগম বলেন, রাস্তায় যেমন তেমন গরম হলেও হাসপাতালে ভেতরে সেদ্ধ হওয়ার উপক্রম। যেন চুলা জ্বলছে। রোগী নিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা যায় না। তাই একটু প্রশান্তির জন্য খোলা জায়গায় ছেলেকে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছি। এখানে উপরে সিলিং ফ্যান নেই। ছোট টেবিল ফ্যান কিনে এনেছি। সেটির জন্যও লাইনের ব্যবস্থা নেই। অবশেষে দুটি প্লাস্টিকের হাত পাখা কিনে এনে বাতাস করছি।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আসলে গরমে মানুষ কষ্ট করছে। এই গরম থেকে রেহাই পাচ্ছেন না হাসপাতালে রোগীরাও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ওয়ার্ডে সব সিলিং ফ্যান চালু রাখা হয়েছে। অনেক জায়গায় পুরোনো ফ্যান খুলে নতুন ফ্যান লাগানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ওয়ার্ডের সিলিং অনেক উপরে থাকায় ফ্যানের বাতাস রোগীর গায়ে পৌঁছাতে পারে না। এ কারণে বেশ কিছু ওয়ার্ডে লোহার পাইপের সঙ্গে সিলিং ফ্যান জোড়া দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক প্লাগগুলো সচল রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেন রোগীরা বাইরে থেকে কিনে আনা তাদের ছোট ছোট ফ্যানগুলো চালু রাখতে পারেন।

https://www.dailysangram.info/post/554041