১৭ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ৫:৫০

একই পরিবারে পাঁচজনসহ ১৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু

ফরিদপুর সদরে যাত্রীবাহী বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১৪ জনের প্রাণ গেছে; এতে আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন। নিহতরা সবাই পিকআপের যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনাটি তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে সদর উপজেলার কানাইপুরের তেঁতুলতলা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান ফরিদপুর কোতোয়ালী থানার ওসি হাসানুজ্জামান।

খবর পেয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে ফায়ার সার্ভিস, হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশের সদস্যরা উদ্ধারে নামেন।

এক পরিবারের নিহত পাঁচজন হলেন বোয়ালমারী উপজেলার বেজিডাঙ্গা গ্রামের রাকিবুল ইসলাম মিলন (৩৮), তার স্ত্রী সুমি বেগম (৩৫) ও দুই ছেলে রুহান (৮) ও হাবিব সিনান (৩) ও মিলনের মা মর্জিনা বেগম (৭০)। নিহত অন্যরা হলেন- আলফাডাঙ্গা উপজেলার চরবকাইল গ্রামের তবিবুর খান (৫৫), বেজিডাঙ্গা গ্রামের জাহানারা বেগম (৫৬), সোনিয়া বেগম (৫৮), নুরারী (২), পিকআপ চালক কুসুমদি গ্রামের নজরুল ইসলাম (৩৫), হিদাডাঙ্গা গ্রামের শুকুরুন নেছা (৮৫), কহিনুর বেগম (৭০) ও সূর্য বেগম (৫৫) ও ইকবাল হোসেন (৪৫)।

পুলিশ ও স্বজনরা জানিয়েছেন, রফিক ঢাকায় একটি সরকারি অফিসে লিফটম্যানের চাকরি করেন। ঈদের ছুটি শেষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সকালে ঢাকার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। বাসে সিট না পেয়ে পথে আলফাডাঙ্গা উপজেলা থেকে ছেড়ে আসা একটি পিকআপে উঠেছিলেন তারা। পথে ঢাকা থেকে মাগুরাগামী ইউনিক পরিবহনের বাসের সঙ্গে পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই পিকআপের চালকসহ ১১ জন নিহত হন। আহতদের ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে আরও দুইজন মারা যান; বাকিরা চিকিৎসাধীন। আর বেলা সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকায় নেওয়ার পথে ইকবাল হোসেন নামে আরও একজনের মৃত্যু হয় বলে জেলার পুলিশ সপার মোর্শেদ আলম জানান।

প্রত্যক্ষদর্শী কানাইপুরের দিগনগর গ্রামের বাসিন্দা সাহানা বেগম বলেন, “ঘটনাস্থলে আসার পর যাত্রীবাহী বাসটির একটি চাকা গর্তে পড়ে যায়। এতে গাড়িটি আড়াআড়িভাবে সড়কে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় পিকআপটি এসে বাসটির সামনে সজোরে আঘাত করে।”
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হাসপাতালে হতাহতদের দেখতে যান।

জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ও আহত প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে। দাফনের জন্য প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

কোতোয়ালী থানার ওসি হাসানুজ্জামান জানান, পরিচয় শনাক্ত করার পর লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
ত্রাণ আনতে গিয়ে লাশ হলেন একই পরিবারের ৫ জন : “কয়েকদিন আগে ঝড়ে ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছিল, তাই ত্রাণের টিন আনতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাকিবুল ফরিদপুর রওনা হয়। “গতরাতে সবশেষ তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। বলেছিল, ত্রাণের টিনগুলো পেলে পরিবারের সদস্যদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে ওই পথেই ঢাকা চলে যাবো। কিন্তু এটিই যে তার শেষ যাওয়া সেটি কী কেউ জানত।” বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রাকিবুল ইসলাম মিলন মোল্যার মামাত ভাই নুরুজ্জামান খসরু।

নিহত ৪২ বছর বয়সী রাকিবুল ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নের ছত্রকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার সন্তান। দুর্ঘটনায় তার সঙ্গে পরিবারের আরও চারজনের প্রাণ গেছে। তারা হলেন-তার স্ত্রী সুমি বেগম (৩৫), বড় ছেলে রুহান (৯), ছোট ছেলে হাবিব ছিনান (৬) ও নানি শাশুড়ি মর্জিনা বেগম (৭০)। রাকিবুল ঢাকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিফট অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন বলে পুলিশ ও স্বজনরা জানিয়েছেন।

বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন রাকিবুলের চাচাত ভাই। তিনি বলেন, “ফরিদপুর ডিসি অফিসের ত্রাণ শাখা থেকে ত্রাণের টিন আনার জন্য গতকাল মঙ্গলবার সকালে পিকআপ ভ্যানে করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফরিদপুর যাচ্ছিলেন রাকিবুল। পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।”

শেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, “একই পরিবারের পাঁচ ব্যক্তির মারা যাওয়ার খবর ছত্রকান্দা গ্রামের পৌঁছালে গোটা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে।“এর আগে আমাদের এই ইউনিয়নে একই পরিবারের এতগুলো মানুষের একসঙ্গে মৃত্যু বা প্রাণহানি হয়নি।”

এদিকে এ দুর্ঘটনার খবরে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে নেওয়া হলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

তিন ভাইবোনের মধ্যে রাকিবুল মেঝো ছিলেন। তার বড় ভাই ফরিদুল ইসলাম স্কুল শিক্ষক; ছোট ভাই হাবিবুর রহমান মাস্টার্স পাশ করে আলফাডাঙ্গা সদরে ফ্লেক্সিলোডের দোকান চালান বলে রাকিবুলের মামাত ভাই নুরুজ্জামান খসরু জানান।

দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে কানাইপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বেলায়েত ফকির বলেন, “যাত্রীবাহী বাস এবং পিকআপ ভ্যান দুটি যানই অতিরিক্ত গতিতে চলছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি দুইটি নিজেদের লেন থেকে বাইরে যাওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া নিহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ৫ লাখ এবং আহতদের পবিারের জন্য ৩ লাখ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে বলে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার জানিয়েছেন।

ফরিদপুরের জেলা পুলিশ সুপার মোরশেদ আলম বলেন, “সড়কে আমাদের চলাচলে আরও সচেতন হতে হবে, না হলে মৃত্যুর মিছিল থামবে না। শুধু যাত্রীদেরেই নয় মালিক ও শ্রমিকদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে।”

https://www.dailysangram.info/post/553795