৪ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৪:২৪

বান্দরবানে তিন ব্যাংকে সশস্ত্র হামলা টাকা-অস্ত্র লুট ॥ ম্যানেজারকে অপহরণ

বান্দারবানে ১৬ ঘন্টার ব্যবধানে তিনটি ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা ও অস্ত্র লুট করেছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। মঙ্গলবার রাতে জেলার রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা লুট, অস্ত্র ছিনতাই ও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনার রেশ কাটতে গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে যায় বলে জানা যায়। থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের শাখায় এই সশস্ত্র হামলা হয়েছে। এরপর সাড়াশি অভিযানে নামে পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলা সদরের সোনালী ব্যাংকে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রাত সাড়ে ৯টায় একদল সশস্ত্র ডাকাত হামলা চালিয়ে ব্যাংকটির গ্রিল ভেঙে লকারে থাকা টাকা, নিরাপত্তায় ব্যবহৃত ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে। এসময় তারা ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। বর্তমানে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. দিদারুল আলম জানিয়েছেন, ব্যাংকটিতে ডাকাতির ঘটনায় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করা হয়েছে। ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক বান্দরবান অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ ওসমান গণি জানিয়েছেন, সোনালী ব্যাংক রুমা শাখায় ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে। রুমা শাখায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা থাকার কথা। সেগুলো ভল্ট ভেঙে নিয়ে গেছে। এই ঘটনার পর এ অঞ্চলের ব্যাংকের সব শাখায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৯টার দিকে কেএনএফের ৭০ থেকে ৮০ জন সশস্ত্র সদস্য রুমা উপজেলা পরিষদ এলাকা ঘেরাও করে। তারা সোনালী ব্যাংকে গিয়ে পাহারারত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং মারধর করতে থাকে। ব্যাংকে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। রুমার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিদারুল বলেন, কেএনএফের সদস্যরা সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা লুটপাট করেছে। ব্যাংকের পাহারারত পুলিশ-আনসার সদস্যদের চারটি হাতিয়ার লুট করে নিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, কেএনএফ সন্ত্রাসীরা মসজিদে মুসল্লিদেরও মারধর করে তাদের মুঠোফোনও নিয়ে গেছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনার পর উপজেলা পরিষদ এলাকায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফের সদস্যরা ৮টি চায়নিজ রাইফেল, দুইটি এসএমজি, ৪টি শটগান ও ৪১৫টি গুলী লুট করে নিয়ে গেছে। তাদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের এক কর্মচারী আহত হয়েছেন। রুমা উপজেলা পরিষদ উপজেলা শহর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে বেথেলপাড়ার কাছাকাছি। বেথেলপাড়ায় গত ৫ মার্চ কেএনএফের সঙ্গে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে কেএনএফ আর সন্ত্রাসী তৎপরতা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ওই বৈঠকের পরও রুমা উপজেলা সদরসংলগ্ন বম জনগোষ্ঠীর বেথেলপাড়া, মুনলাইপাড়া, এডেনপাড়াসহ বিভিন্ন পাড়ায় কেএনএফের সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছিল।

রুমা উপজেলা মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম বলেন, অস্ত্রধারী ২০ থেকে ২৫ জন মসজিদে ঢুকে পড়ে। তখন আমরা সবাই এশার নামাযে ছিলাম। ফরজ নামায শেষ করে দেখলাম সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নিচ্ছে তারা। নুরুল ইসলাম আরও বলেন, কেএনএফ সদস্যরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফের সদস্যরা দুটি এসএমজি (লাইট মেশিন গান) ও ৬০টি গুলী, ৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলী, ৪টি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ এবং সোনালী ব্যাংকের শাখার দুটি ভল্টের একটি ভেঙে রক্ষিত টাকা নিয়ে গেছে। টাকার পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। অবশ্য সোনালী ব্যাংক বান্দরবান অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ ওসমান গণি মঙ্গলবার রাতে একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রুমা শাখায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা থাকার কথা। এদিকে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কনস্টেবল রূপন শীল বলেন, আমি আর কনস্টেবল তৌহিদ ব্যাংকের সামনে পাহারায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি ইউনিফর্ম পরা অস্ত্রধারী কয়েকজন। তারা আমাদের ব্যারাকে ঢুকিয়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে থাকা অস্ত্র ও মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। তিনি বলেন, সব পুলিশ সদস্যকে মাথা নিচু করে বসিয়ে রাখা হয়। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ব্যারাকে আটকে রাখা হয়। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর চট্টগ্রামের উপমহাপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ রাসেল ঘটনাস্থলে বলেন, তাদের দায়িত্বরত আটজন আনসার সদস্যের মধ্যে চারজন আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ডাকাতিতে শতাধিক কেএনএফ সদস্য অংশ নেয়। তাদের বেশির ভাগের পরনে ইউনিফর্ম ছিল। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ব্যাংক লুটের আগে অস্ত্রধারীরা বান্দরবান-রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের অংশে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়। এলাকাটি নির্জন এবং ঘটনার সময় বিদ্যুৎ ছিল না।

উদ্ধার হয়নি ম্যানেজার: বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে ব্যাংক লুটের পর অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার মো. নিজাম উদ্দিনকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১৭ ঘণ্টা পার হলেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় এখনো থানায় মামলা করেনি কেউ। দুপুরে রুমা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহজাহান কালবেলাকে বলেন, উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তবে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সকালে জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন, পুলিশ সুপার (এসপি) সৈকত শাহিন ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুমা সার্কেল মো. জুনায়েদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সোনালী ব্যাংক পরিদর্শন করেছেন।

ভরদুপুরে থানচির দুই ব্যাংকে ডাকাতি: বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা ও লুটের ১৬ ঘণ্টার মাথায় এবার থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা হামলা চালিয়েছে। এ সময় তারা টাকা লুট করেছে। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে একদল সশস্ত্র লোক দুটি গাড়িতে করে এসে পাশাপাশি থাকা কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক শাখায় হামলা চালায় বলে কৃষি ব্যাংকের থানচি উপজেলার শাখার ব্যবস্থাপক হ্লা সুই থোয়াই জানান। তিনি বলেন, তারা এসে চোখের পলকে আমাদের ব্যাংকে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ফেলল। তারপর সবাইকে একটি কক্ষে নিয়ে বাইরে থেকে আটকে দিল। টাকা লুটের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বলেন, প্রাথমিকভাবে আড়াই লাখ টাকা খোয়া গেছে এটা জানতে পেরেছি। একই সময় পাশের সোনালী ব্যাংকেও হামলা হয় বলে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের ভাষ্য। তবে এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। থানচির ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আব্দুল করিম বলেন, থানচিতে ব্যাংকে হামলা হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। আমাদের ধারণা, গতকালের (মঙ্গলবার) গ্রুপটিই এটা করেছে। ঘটনার তদন্তে কোনো অগ্রগতি এখনও হয়নি। থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন বলেন, দুপুরে থানচি বাজারে এসে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে প্রবেশ করে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে বলে জেনেছি। সোনালী ব্যাংক থেকে ১৪-১৫ লাখ টাকা নিয়ে গেছে বলে শুনেছি। তবে কৃষি ব্যাংক থেকে কত টাকা নিয়েছে জানা যায়নি। সেখান থেকে কাউকে অপহরণ করার সংবাদও পাওয়া যায়নি।

৬ উপজেলার সব ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ: বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে গত দুদিনে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় সদর উপজেলা বাদে জেলার ছয়টি উপজেলার সব ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বান্দরবান সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সব ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কোনো টাকা লুট হয়নি, সিআইডি: বান্দরবানের রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি। ওই ব্যাংকের ভল্টে থাকা সব টাকা অক্ষত আছে। গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ প্রথম আলোকে এ কথা বলেন। শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, সিআইডির চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ইউনিটের দুটি দল রুমায় গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। পরে ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুণে দেখা হয়। দেখা যায়, মঙ্গলবার রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দুটি চাবি একসঙ্গে দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারীরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি। বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা মঙ্গলবার রাতে সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির চেষ্টা করে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, কেএনএফ সদস্যরা ব্যাংকের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ সদস্য এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনে পাহারায় থাকা আনসার সদস্যদের কাছ থেকে দুটি এসএমজি (লাইট মেশিন গান) ও ৬০টি গুলি,৮টি চীনা রাইফেল ও ৩২০টি গুলী এবং ৪টি শটগান ও ৩৫টি কার্তুজ নিয়ে গেছে। মঙ্গলবার রাতে ডাকাতির পর ব্যাংক ও উপজেলা পরিষদের সামনে পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। রয়েছেন র‌্যাবের সদস্যরাও। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন, জেলা পুলিশ সুপার শাহিন সৈকতসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বান্দরবান রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ঢোকার মুখে রয়েছে একটি দোতলা ভবন। এটির নিচতলায় থাকেন সরকারি কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় তলার এক পাশে সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা। আরেক পাশে থাকেন ব্যাংকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১০ জন পুলিশ সদস্য। কেনএনএফের অস্ত্রধারীরা যাওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজামুদ্দিনকে নিয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন বলছেন। বিকেল পর্যন্ত তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিকে বেলা একটার দিকে বান্দরবানের থানচি উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের দুটি শাখায় ডাকাতি করে অস্ত্রধারীরা। তারা সাড়ে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা।

https://www.dailysangram.info/post/553112