১ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১:১৪

সংকটে কাহিল স্বাস্থ্য শিক্ষা খাত

ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা সরঞ্জাম ও জনবলের নিশ্চয়তা ছাড়াই ঘোষণা দিয়ে একের পর এক মেডিক্যাল কলেজ খোলার অনুমোদন দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণ সরঞ্জাম ঘাটতিসহ নানা সংকট চলছে। যথাযথ তদারকি নেই স্বাস্থ্যশিক্ষার গুণগত মানের। এসবের সমাধান না করে নতুন নতুন মেডিক্যাল খোলায় এ সংকট আরো ঘনীভূত হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

এমন পরিস্থিতিতে নতুন চিকিৎসক যাঁরা আসছেন, তাঁদের গুণগত মানে ঘাটতি থাকছে। এতে একদিকে যেমন বহির্বিশ্বে দেশের এমবিবিএস ডিগ্রিধারীর গ্রহণযোগ্যতা কমছে, অন্যদিকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছেও এ দেশে পড়ার আকর্ষণ কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করা ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশনের (ডাব্লিউএফএমই) স্বীকৃতি না থাকায় ও আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ায় বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে।

তাঁরা বলছেন, ডাব্লিউএফএমইর স্বীকৃতি না মিললে বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের এমবিবিএস ডিগ্রি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
দেশে কাজ করতে পারলেও চিকিৎসকরা বিদেশে যেতে পারবেন না, বিদেশে কোনো চাকরি পাবেন না, পড়তে যেতে পারবেন না, কোনো প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবে না। বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়তে আসা এক পর্যায়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ এখানে পড়াশোনা শেষে তাঁরা বিদেশে গিয়ে চাকরি করতে পারবেন না বা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন সম্ভব হবে না।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ২২১টি আসন (সংরক্ষিত কোটা) রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে সার্কভুক্ত দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ১১৭টি এবং অন্য দেশগুলোর জন্য ৯৯টি আসন রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত আসন পাঁচটি। এ ছাড়া বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের মোট ৬৬টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৪৫ শতাংশ হিসাবে দুই হাজার ৫৫১টি আসন সংরক্ষণ করা রয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশনের (ডাব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষক স্বল্পতা, ল্যাবরেটরি সুবিধা, প্রশিক্ষণের চিকিৎসা উপকরণ স্বল্পতা ও মানদণ্ড অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ ও তদারকির অভাব—এই কারণগুলো হলো প্রধান। যে কারণে বাংলাদেশ এখনো ডাব্লিউএফএমই স্বীকৃতি অর্জনে পিছিয়ে আছে।

যেমন অনেক মেডিক্যাল কলেজ আছে, যাদের হাসপাতাল আছে, কিন্তু হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের জন্য তেমন রোগী নেই, মেডিক্যালে ল্যাবরেটরি সুবিধা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই, যে কারণে বহির্বিশ্বে আমাদের সম্পর্কে ধারণা রয়েছে যে, এখানকার মেডিক্যাল কলেজগুলো নিম্নমানের।

মোজাহেরুল হক বলেন, দেশের স্বাস্থ্য শিক্ষার মান দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমঅ্যান্ডডিসি)। এ ছাড়া আর দুটি অথরিটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই তিন পক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার কারণে সত্যিকারে মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এখানে দরকার হলো দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা। দায়বদ্ধতা কার, এ বিষয়ে সরকারকে সুনিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যাঁরা মেডিক্যাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষার মান দেখবেন। নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করবেন। যারা পরিচালন নীতিমালা অনুসরণ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা ভালো করবে, তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিম্নমানের চিকিৎসক তৈরি করার চেয়ে না করা ভালো।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডাব্লিউএফএমই স্বীকৃতি অর্জনে আমরা কাজ শুরু করেছি। একটি কমিটিও হয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই আমার ডাব্লিউএফএমই স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম হব।’
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমি প্রায়ই একটি কথা বলি, চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে ভালো মানুষ ও ভালোমানের চিকিৎসক হওয়া জরুরি। আমরা সেদিকে বিশেষ জোর দিয়েছি।’

গত ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের চিকিৎসক অধ্যক্ষদের এক সম্মেলনে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোয় আটটি মৌলিক বিষয়ে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, কিউরেটর ও প্রভাষকের পদ আছে দুই হাজার পাঁচটি। এর মধ্যে ৫৮৮টি পদে কোনো শিক্ষক নেই। অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে গড়ে ২৯ শতাংশ শিক্ষক ছাড়াই সারা দেশে মেডিক্যাল শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।

এসব শিক্ষকের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতায় এগিয়ে থাকেন অধ্যাপকরা। কিন্তু সারা দেশে অধ্যাপকের সংকট চলছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোয় মৌলিক বিষয়ে অধ্যাপকের পদ আছে ২১৩টি, কাজ করছেন ৬৫ জন। অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে ৭০ শতাংশ অধ্যাপকের পদ খালি।

নিয়ম অনুযায়ী, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজের কোনো বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদিত পদের ২৫ শতাংশের বেশি রাখা যাবে না। এসব কলেজে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে দুই একর এবং ডেন্টাল কলেজের জন্য এক একর জমি থাকতে হবে। অন্য এলাকায় এই জমির পরিমাণ চার একর ও দুই একর হতে হবে। মেডিক্যাল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ এবং এর অধীন পরিচালিত হাসপাতাল কোনোভাবেই ইজারা বা ভাড়া নেওয়া জমিতে বা ভবনে স্থাপন করা যাবে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই নীতিমালা পরিপূর্ণভাবে মানছে না। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ নীতিমালা মানতে প্রায় শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ, উন্নতমানের ল্যাবরেটরি, শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর সুবিধা পর্যাপ্ত নেই। ফলে এগুলো থেকে পাস করা চিকিৎসকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটো মিঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি বছর এখনো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়নি। আবেদন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রায় এক হাজার ৭০০ আবেদন জমা পড়েছে প্রাইভেটে। গত বছর বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৩০০ জনের মতো। সেই হিসাবে তাঁদের হার প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে বলা যায়।

ডা. মো. টিটো মিঞা বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ হলো ভারত ও নেপালে প্রাইভেট মেডিক্যালের সংখ্যা বেড়েছে। এই দুই দেশ থেকে আগে বাংলাদেশের মেডিক্যালে পড়তে আসা শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি ছিল। এ ছাড়া তারা টিউশন ফি অর্ধেক কমিয়েছে। যেমন আগে ভারতে বেসরকারি মেডিক্যালে পড়তে প্রায় এক কোটি রুপি লাগত, এখন তারা সেই খরচ ৫০ লাখ রুপি কমিয়েছে। এর সঙ্গে ডাব্লিউএফএমই স্বীকৃতি না থাকাও আমাদের দেশে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার একটি কারণ। ভারত, নেপাল ও চীন এ স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরাও এ নিয়ে কাজ করছি। এরই মধ্যে কাউন্সিল হয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটে বাংলাদেশ পিছিয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/04/01/1376437