১ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১:১২

বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ায় উদ্বেগ

ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধে সরকারের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে সুদ বেড়ে ৮০ কোটি ৬০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে একই সময়ে সুদ পরিশোধে সরকার খরচ করেছিল ৪০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থ্যাৎ সুদ পরিশোধের পরিমাণ ২০০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে। বিষয়টি উদ্বেগের। আর এই অবস্থার অন্যতম কারণ হলো গত এক দশকে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু ঋণ নিয়েছে। অন্যদিকে এসব ঋণের সুদহারও তুলনামূলক বেশি।
ইআরডি’র প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে বিদেশি ঋণদাতাদের সুদ-আসল মিলিয়ে ২০৩ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৪২ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এ ছাড়া জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বৈদেশিক ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১০২ কোটি ১১ লাখ ডলার।
এদিকে ইআরডি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ এবং বাজেট সহায়তার ঋণের জন্য ১.১৯ বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করতে হবে। এরপর ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ করতে যথাক্রমে ১.৩১ এবং ১.৪১ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৯২ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের হিসাব ছিল ৯২৭ মিলিয়ন ডলার।

শুধু সুদ পরিশোধই নয়, আগামী দুই বছরের মধ্যে আসল পরিশোধ বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা ইআরডি’র। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ১.৪১৮ বিলিয়ন ডলার। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১.৮৪৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২.৩৭ বিলিয়ন ডলারে। বেশকিছু বড় প্রকল্পে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা শেষ হওয়ার প্রভাবে পরের দুই অর্থবছর আসল পরিশোধ করতে হবে যথাক্রমে ২.৯০ এবং ৩.৩১ বিলিয়ন ডলার। আগামী অর্থবছরে সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার।

ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে পরিশোধের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩.৫৬৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এরপরের অর্থবছর থেকে সুদ ও আসল পরিশোধ ৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগীদের দিতে হবে ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আসল ও সুদ মিলিয়ে পরিশোধ করে ১.৯১৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে এর পরিমাণ ছিল ২.৭৯০ বিলিয়ন ডলার।

ইআরডি সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২.৬৬৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। এই ঋণের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। ফলে চলতি অর্থবছর থেকে এ ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ১৫ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২৬ সালের শেষে রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নেয়া ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। ২০ বছর মেয়াদের এ ঋণের জন্য প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে। একই সময়ে মেট্রো রেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ঋণের আসল পরিশোধও শুরু হবে। তখন বার্ষিক আসল পরিশোধ পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এতে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে বড় উল্লম্ফন ঘটবে।

ইআরডি’র কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে সোফর রেটে বাজেট সহায়তা নেয়ার কারণে সুদ পরিশোধের চাপ আরও বেড়েছে। বাজেট সহায়তা-সুদ পরিশোধের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল পরিশোধেও চাপ বাড়িয়েছে। এ ছাড়া, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো বেশকিছু মেগাপ্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর এসব প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ ক্রমে বাড়ছে। রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রো রেলের মতো বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরও বেড়ে যাবে।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মানবজমিনকে বলেন, আমরা দুই বছর আগেই বলেছিলাম, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এও বলেছিলাম, ২০২৪ সালের পর থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমাদের সে বক্তব্যকে সরকারের নীতি প্রণেতারা তখন পাত্তা দেননি এবং নানা যুক্তি দিয়ে তারা বুঝিয়েছিলেন, বিদেশি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এখন সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থণৈতিক কারণে বিষয়টি যতটা উদ্বেগের, নীতি প্রণেতাদের অস্বীকার, অবজ্ঞা ও অবহেলা তার চেয়ে বেশি উদ্বেগের।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে একটি অনুষ্ঠানে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘২০১৮ সালের পর দায়দেনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আর শীর্ষ ২০টি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের বড় ধাক্কা আসবে ২০২৪ ও ২০২৬ সালে। ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় অংশ ৩৬.৬ শতাংশ যাবে রাশিয়ার কাছে, এরপর জাপানে যাবে ৩৫ শতাংশ এবং চীনের কাছে প্রায় ২১ শতাংশ। পরিমাণের হিসাবে চীন তৃতীয় হলেও ঋণ পরিশোধের সময়সূচি অনুযায়ী তাদেরই বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। এ বিরাট ধাক্কা সামলাতে কর আহরণ বাড়াতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=104129