১ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১:১১

নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরবেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা

ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত ও অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত থাকলে এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে শিগগিরই একাডেমিক (শিক্ষা) কার্যক্রমে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাঁরা একই সঙ্গে পরীক্ষাগুলোর তারিখ পুনর্নির্ধারণ করারও আবেদন করেছেন।

বুয়েট ক্যাম্পাসের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে আজ রোববার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজন লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান।

শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। লিখিত বক্তব্যে তাঁরা বলেছেন, ‘ক্ষমতার লোভ এবং অপচর্চা আবারও এসে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে না ফেলুক। আমরা সব শিক্ষার্থীই গর্বের সঙ্গে আমাদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনার চর্চা আমাদের অন্তরে লালন করি।

গত বুধবার (২৭ মার্চ) মধ্যরাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রবেশের প্রতিক্রিয়ায় ২৯ মার্চ থেকে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক (শিক্ষা) কার্যক্রম বর্জন করে চলেছেন। আজ সকাল সাতটা থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের জড়ো হওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা সেখানে যাননি। পরে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা।

এর আগে আজ দুপুরে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন চালুর দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন। বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে এই সমাবেশ হয়। পরে সমাবেশ শেষে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে যান এবং কিছু সময় শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করেন।

বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের পক্ষে আন্দোলনরত সব ব্যাচের সব শিক্ষার্থী রোববার নিরাপত্তাজনিত তীব্র শঙ্কার কারণে কেউ কোনো ধরনের সমাগম করেননি। ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় শনিবার রাত থেকে ক্রমাগত মাইকিং, শিক্ষার্থীদের ফোন কলে হুমকি–ধমকি দেওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মিথ্যা ‘ট্যাগ’ (পরিচিতি দেওয়া) দেওয়া, শিক্ষার্থীদের ছবি-নাম-পরিচয়সহ পোস্ট করে তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়, এমন সব অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এ অবস্থায় বুয়েট ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকা বুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নিরাপত্তাজনিত এসব বিষয়ে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়া মানে এই নয় যে ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবি থেকে বুয়েট শিক্ষার্থীরা সরে এসেছেন। তাঁদের অবস্থান কোনো একক ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, বরং বুয়েট ক্যাম্পাসে দেশের সব ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি ছাড়াও সুস্থ নেতৃত্ব এবং নৈতিকতা বিকাশের সব উপাদান ক্যাম্পাসে গত কয়েক বছর উপস্থিত ছিল। সুস্থ নেতৃত্ব চর্চার জন্য শিক্ষার্থীরা তাঁদের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে।

বুয়েটের সব শিক্ষার্থী গর্বের সঙ্গে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার চর্চা অন্তরে লালন করেন বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বুয়েটের সব শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে দেশবাসীর সামনে সৎ সাহসের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলতে চায়, ‘বুয়েটের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা, তার সঙ্গে বুয়েটের সব শিক্ষার্থীই একাত্মতা পোষণ করে।’

নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রমের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্যাম্পাসে এদের কর্মকাণ্ড দেখা যায় বহিরাগতদের লাগানো বিভিন্ন পোস্টার, ই–মেইল বা প্রচারপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে। কারা এগুলো করেন, তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট নন। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা হিযবুত তাহরীরের সম্পূর্ণ বিপক্ষে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এ–জাতীয় অপশক্তির উত্থান যেন বুয়েটে না হয়, সে জন্য তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ছাত্রশিবিরের রাজনীতি প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শিবিরের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগ আসছে, তাঁদের ঘটনাটি বুয়েটের বাইরে হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত এই ঘটনার বিষয়ে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাঁদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিতভাবে আহ্বান জানাই এবং এটি আমাদের পূর্বের একটি আন্দোলনের অন্যতম দাবি হিসেবে ছিল।’

ওই মামলা আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন আছে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘বিচারপ্রক্রিয়ার রায় সাপেক্ষে যদি এ রকম কোনো শিক্ষার্থীর শিবির–সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, আমরা তাৎক্ষণিক তাদের বহিষ্কারের দাবি জানাব। ...আমরা দেখতে পাই মিডিয়ায় ছাত্রশিবিরের সাবেক প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, উনাদের বুয়েটে কার্যক্রম আছে। কোনো প্রমাণ ব্যতীত এই ধরনের বক্তব্যের আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং একই সঙ্গে যদি কারো শিবিরের কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায়, আমরা সে ক্ষেত্রে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা, কমিটি দেওয়া, ক্যাম্পাসে শোডাউন, রাজনৈতিক সংগঠনের জনসমাবেশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত রাখার বিধি লঙ্ঘন। এ ছাড়া রাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ যেখানে বুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ, সেখানে রাত তিনটায় একটা রাজনৈতিক সংগঠনের সাংগঠনিক নেতাদের দলবল কর্মসূচি করা অবশ্যই একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয় এবং সাংগঠনিক রাজনীতির প্রভাবে ঘটা কোনো ঘটনা। দফায় দফায় প্রতিবাদ জানানোর পরও ছাত্রলীগ-সংশ্লিষ্টরা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসের ইচ্ছাকে সম্মান না করে ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছেন। ক্রমাগত অসন্তোষ এখন তীব্র আন্দোলনে রূপ নিয়েছে শুধু একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস চাওয়ার দাবি থেকেই।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমরা শপথ করছি, সব রাজনৈতিক ও নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে বুয়েটকে মুক্ত রাখার। আমরা আবরার ফাহাদ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’

https://www.prothomalo.com/bangladesh/dh86t250br