৩১ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ১:১৫

রমযানেও অস্থির চালের বাজার কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা

চরম মূল্যস্ফীতির এই বাজারে হঠাৎ চালের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত আয়ের ক্রেতারা। সপ্তাহের ব্যবধানে চালের বাজারে কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা। এদিকে হঠাৎ চালের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে ধান সংকটকে দায়ী করছেন মিলাররা। আগামীতে চালের দাম আরও বাড়তে পারে বলে সতকর্তা তাদের। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি চালের আমদানি বাড়ানোর কথা বলেছেন।

সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের চিকন ও মোটা সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। রমযানের এ সময়ে চালের চাহিদা কিছুটা কম। বাজারে সরবরাহও রয়েছে। তার মধ্যেই চালের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, বাজারে মোটা চালের কেজি ২ টাকা বেড়ে ৫২ টাকা হয়েছে। আর সরু চাল তিন টাকা বেড়ে ৬৫ থেকে ৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে ঘুরে এ ধরনের চাল আরও বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে

আগে স্বর্ণার কেজি ৫০-৫১ টাকা ছিল তা এখন ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা। পাইজাম ও বিআর ২৮ কেজি ৫৫-৫৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৭-৬০ টাকা। আর রশিদ মিনিকেট ৭২ থেকে ৭৪ টাকা ও মোজাম্মেল মিনিকেট ৭৮ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে মোজাম্মেল মিনিকেট চাল উধাও।

ভাটারা নুরেরচালা মতিন স্টোরের মালিক মো. মতিন বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তে মোজ্জাম্মেল মিনিকেট নেই। অথচ বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। মনে হচ্ছে চালের দাম আরও বাড়তে পারে। রশিদ মিনিটেক ও মোজাম্মেল মিনিকেটের মালিক চালের বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা খুচরা বিক্রেতারা আড়তদারের কাছে জিম্মি।

কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চালের মোকামে কথা বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দামের কারসাজির নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে মিনিকেট ব্যবসায়ীদের একাধিক সিন্ডিকেট।

খিলক্ষেত বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরের মালিক বশির উদ্দিন বলেন, পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই
গুলশানের শাহজাদপুরের বাজারে চাল কিনতে আসা মো. সেলিম বলেন, হঠাৎ করেই দেখি সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। আমি এক সঙ্গে পুরো মাসের চাল কিনে নেই। শুক্রবার মিনিকেট মোজাম্মেলের কেজি দোকানভেদে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যে চাল এক মাস আগেও কিনেছি ৭৩ টাকা কেজি।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে পর্যাপ্ত ধান পাওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তাও কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। তাই চাল উৎপাদনের খরচও বেড়ে গেছে।

মিল মালিকরা বলছেন, ধান সঙ্কটের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করার পর আমাদের তো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানির উপায় নেই। আর সেখান থেকে চাল আনতে গেলে মোটা চালের দাম কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা পড়বে। তাই এবার আমরা আমদানি করছি না।

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কুষ্টিয়া শাখার সভাপতি ওমর ফারুক জানান, সরু চালের জন্য প্রসিদ্ধ কুষ্টিয়ার মোকামে ধানের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে চালের দাম কেজিতে ২-৪ টাকা বেড়েছে। প্রায় সবরকম চালই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর কারণে মোকামে উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বেচাকেনাও হচ্ছে না তেমন একটা। তিনি বলেন, অন্যান্য বার রমযানে চালের দাম খুব একটা বাড়ে না। কিন্তু এবারই চালের দাম বেড়েছে। বাজারে ধানের সংকট থাকায় এমনটি হয়েছে।

কুষ্টিয়া পৌর বাজারের বিক্রেতা রঞ্জুর হোসেন নিশান জানান, তার দোকানে আগের চেয়ে বেচাকেনা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ক্রেতারা দোকানে আসছেন না। আবার মোকামে গিয়েও চাল আগের মতো পাচ্ছেন না। পেলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই চালের দাম বাড়িয়েছেন মিলাররা।

এই বিক্রেতা বলেন, আগে যেখানে মিনিকেট (সরু) চাল ৬৪ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি, সেই চাল সপ্তাহ ব্যবধানে বিক্রি করতে হচ্ছে ৬৮ টাকা কেজিতে। একই অবস্থা কাজললতা, আটাশ, বাঁশমতিসহ অন্যান্য চালেও। কাজললতা ৫৮ টাকা থেকে বেড়ে ৬২ টাকা, বাঁশমতি ৭৪ টাকা থেকে বেড়ে ৭৮ টাকা এবং আটাশ চাল ৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রমযানের শুরুতেই চালের বাজার অস্থির বলে জানান তিনি।

চালকল মালিকরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে ধানের ভীষণ সংকট। বেশি দামেও ধান মিলছে না। কারণ কৃষকের গোলায় ধান নেই। এ বিষয়ে খাজানগরের দেশ এ্যাগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকারী এমএ খালেক জানান, তারা বেশি দাম দিয়েও ধান কিনতে পারছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বড় করপোরেট ব্যবসায়ীরা বাজার কিংবা কৃষক পর্যায় থেকে অধিকাংশ ধানই কিনে রেখেছেন। তাই আমাদের মতো ক্ষুদ্র মিলাররা ধানের সংকটে পড়েছেন।

তিনি বলেন, সপ্তাহ দু-এক আগেও যে ধান প্রতি মণ ১৬শ ৫০ টাকায় কিনেছি, সেই ধান এখন প্রায় ১৮শ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে ধান নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে এখানকার অধিকাংশ চালকল বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে আগামী বৈশাখ মাসের আগে অর্থাৎ নতুন ধান না উঠলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই।

কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির একাংশের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, মূলত তৃতীয় রমযানের পর থেকে চালের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান সংকটের কারণে চালের দাম বেড়েছে। তবে ঈদের পর নতুন ধান উঠলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

অর্থনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন ভূইয়ার মতে, দেশে সম্প্রতি অনেক করপোরেট ব্যবসায়ী চাল ব্যবসায়ে ঝুঁকেছেন। চাল উৎপাদনে প্রচুর ধান প্রয়োজন তাদের। তাই বাজারের অধিকাংশ ধান তারা কিনে গুদামজাত করছেন। যার কারণে কুষ্টিয়ার মতো ছোট ছোট মিলার ধান সংকটে ভুগছেন। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বড় বড় মিলার কারসাজির সুযোগ পাচ্ছেন। তবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চালের আমদানির বিকল্প নেই দাবি এই অর্থনীতি বিশ্লেষকের। তিনি বলেন, চালের আমদানি শুরু হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। একই সঙ্গে বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় চালের বাজার বাহাদুর বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী রঞ্জিত বলেন, দিনাজপুরে চালের দাম একবার বাড়লে আর কখনোই কমে না। বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চাল কিনতে আসা জহুরুল জানান, সারা দিন অটো চালিয়ে যা আয় রোজগার করেন, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন।

দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হুমায়ুন রেজা শামীম বলেন, দিনাজপুরের হাটবাজারে চালের সরবরাহ নেই। মিল মালিকরা চাল কিনতে পারছেন না। সামনে ইরি ধান উঠলে চালের দাম কিছুটা কমবে। ধান না উঠা পর্যন্ত দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

https://www.dailysangram.info/post/552724