২২ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৪:৩৩

এক বছরে পেশা ছেড়েছেন প্রায় ১৬ লাখ কৃষক

দেশে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে দেশ। তবে দেশের খাদ্যের জোগানদাতা কৃষকই এখন সবচেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ২৬.৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবেও সামনে আসছে কৃষি।
এরই মধ্যে বিভিন্ন কারণে গত এক বছরে কৃষি পেশা ছেড়ে দিয়েছেন প্রায় ১৬ লাখ মানুষ।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের কৃষকরা উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন করলেও নিজের জন্য কিছুই রাখতে পারেন না। এমনকি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উৎপাদিত ফসল মাঠেই বিক্রি করতে বাধ্য হন। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে কৃষক নিজে যে খাদ্য ফলান, একটি পর্যায়ে গিয়ে তিনি তা-ই বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিবিএসের খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩-এ বলা হয়েছে, পেশাগত জায়গায় শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারের মধ্যে গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২৬.৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কৃষক পরিবার নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সংকটে রয়েছেন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অন্য পেশাগুলোর ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর চেয়ে অনেক কম। যাঁরা শিল্প খাতে কাজ করেন তাঁদের খাবারের বিপদ সব পেশার মধ্যে সবচেয়ে কম।

শিল্পের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ১৬.৬৪ শতাংশ। সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীলদের ক্ষেত্রে তা ২০.২৮ শতাংশ, প্রবাসী আয় গ্রহণকারী পরিবারের ২০.০৩ শতাংশ, অন্য পেশার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২১.৫৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশের গড় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২১.৯২ শতাংশ। আর চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ০.৮৩ শতাংশ।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের ডিসেম্বরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কৃষিকাজ ছেড়েছেন ১৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ।

বিভিন্ন হতাশার কারণে তাঁরা এ পেশাই ছেড়ে দিয়েছেন। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, আয়ের বৈষম্য, যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজের ক্ষেত্র কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে কৃষি পেশা ছাড়ছে মানুষ। অনেক কৃষকই এখন নিজের দেশে চাষ করার বদলে বিদেশে গিয়ে অন্যের জন্য ফসল ফলাচ্ছে। বর্তমানে বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই যাচ্ছেন কৃষিকাজে।

শ্রমশক্তি জরিপ (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তথ্য অনুযায়ী, কৃষি পেশায় যুক্ত কর্মী তিন কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষেও সংখ্যাটি ছিল তিন কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার।

কৃষকদের নিজের পেশা ছেড়ে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে। বিবিএস এখন জিডিপির হিসাব প্রতি প্রান্তিকেই দিয়ে থাকে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের জিডিপি দাঁড়ায় ৬.০৭ শতাংশ। এ প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি এতটা কমেছে যে দেশের খাদ্য উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ০.৮৪ শতাংশ। অথচ এর আগের অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২.০৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষির প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ কয়েক বছর ধরে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে কৃষি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে। ফলে খাদ্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতা আরো বাড়ছে।

কৃষকদের এত বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. খন্দকার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কৃষকরা বিশেষ করে এখন যে উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য এসেছে সেগুলো উৎপাদন করে বিক্রি করে ফেলেন। তাঁরা নিজের খাবারের জন্য যা রাখেন সেগুলো খুবই সামান্য, অপুষ্টিকর। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তাঁদেরই বেশি হবে। যেমন—তাঁরা দুধ বিক্রি করে ফেলেন, নিজের জন্য রাখেন না। দুধ পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও নিজের জন্য রাখেন না। তাঁরা দুধ বিক্রি করে খাদ্য, কাপড়সহ অন্য কিছু কেনেন।’

খন্দকার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কম। সে হিসাবে তাঁরা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারেন না। তাঁরা যেসব শাক-সবজি খান সেগুলোও একেবারেই নিম্নমানের, সব বিক্রি করার পর যা থাকে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পুষ্টি নিয়ে তাঁদের শিক্ষা বা সচেতনতা কম। সে জন্যও তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি।

দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা যে রয়েছে তা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন কৃষিমন্ত্রী আবদুস শহীদ নিজে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ফসল সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল ও খাদ্য নষ্ট এবং অপচয় হয়। খাদ্য নষ্ট হওয়া ও অপচয় কমাতে পারলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/03/22/1373607