২০ মার্চ ২০২৪, বুধবার, ১০:৪৭

বেপরোয়া নৌদস্যুরা

ভারত মহাসাগর থেকে সোমালি নৌদস্যুদের অপহরণের শিকার বাংলাদেশি কার্গো জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে আট দিনেও কোন কূল কিনারা হয়নি। সব শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দস্যুরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা জিম্মি ২৩ নাবিকদের গায়ে হাত না তুললেও নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করছে। জাহাজে মজুদ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি দিনে অন্তত একশ’ জনের খাবার নষ্ট করে ফেলছে। এতে দ্রুত খাবার এবং পানি ফুরিয়ে আসছে।

গত সপ্তাহে মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে জাহাজটি দখলে নেয়ার পর এ কয়দিন নাবিকদের পরিবারের সাথে যোগাযোগসহ ও অন্যান্য কিছু সুবিধা দিলেও গত দুই দিনে তারা সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে। নাবিকদের পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে জিম্মি ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি উদ্ধারে বহুজাতিক বাহিনীর সাঁড়াশি সামরিক অভিযানের খবরে জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে উৎকন্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের আশঙ্কা কোন রকম সামরিক অভিযান শুরু হলে রক্তপাত এবং জিম্মিদের জীবন হানিও হতে পারে। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

নৌদস্যুদের কবল থেকে জাহাজটি উদ্ধারে অভিযান পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও নাবিকদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাতে সায় দেয়নি বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার জাহাজটির মালিক পক্ষ চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের তরফেও অভিযানের বদলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জিম্মিদের উদ্ধারে সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।

এর আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এমভি আব্দুল্লাহ এবং জিম্মি নাবিকদের নৌদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ। এছাড়া, রোববার এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইয়ের সাথে অভিযুক্ত দুইজন নৌদস্যুকে আটকের কথা জানিয়েছে পান্টল্যান্ড পুলিশ।

সোমালিয়ার একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমভি আবদুল্লাহকে দখল করে থাকা নৌদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ভারতীয় কমান্ডোরা নৌদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আবদুল্লাহতেও অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এই ধরনের অভিযানের প্রস্তাবে বাংলাদেশের সরকার রাজি হয়নি।

জাহাজটির মালিক কোম্পানি কেএসআরএম গ্রুপও এই ধরনের অভিযানে রাজি নয়। প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জিম্মি নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। যে অভিযানে নাবিক ও ক্রুদের জীবন বিপন্ন হয় এমন কোনো অপারেশন আমরা চাই না। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সব মহলকে জিম্মি উদ্ধারে শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজতে অনুরোধ করেছি। সরকারি তরফেও এমন বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই কোম্পানির আরো একটি জাহাজ এমভি জাহান মণি ছিনতাই করার ১০০দিন পর ২৬ জন জিম্মিকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে আনা হয়েছিল।

এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জাহাজটি উদ্ধারে সামরিক অভিযানের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নাবিকরা তাদের পরিবারকে জানিয়েছেন, নৌদস্যুরা জাহাজে থাকা খাবার শুধু খাচ্ছেই না, সেগুলো নষ্টও করছে। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানান জিম্মি নাবিকরা। জিম্মি থাকা ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের সাথে তার বড় ভাই ওমর ফারুকের সর্বশেষ কথা হয় দু’দিন আগে।

ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে জানান, তখন সে জানিয়েছিলো নৌদস্যুরা প্রতিদিন প্রায় একশো জনের খাবার নষ্ট করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড় সংকটে পড়তে হবে তাদের। জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার দেখার পর থেকে ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে আমরা জেনেছি। অভিযান চললে আমরা আর আমাদের সন্তানদের জীবিত ফেরত পাবো না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমাদের সাথে শেষ যখন কথা হয়েছে তখন আমার ছেলে আমাকে বলেছে দিকে ওরা গায়ে হাত না দিলেও অনেক দুর্ব্যবহার করা শুরু করেছে।

পরিবারের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও নৌদস্যুদের নিয়ন্ত্রণের থাকা জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান মনিটর করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমএমওএ) জাহাজটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। দস্যুবাহিনী জাহাজটিকে নিয়ে কয়েক দফায় ভারত মহাসাগরে স্থান পরিবর্তন করে। জাহাজটির এই গতিপথ ও অবস্থান দেখে বিএমএমওএ বলছে, জাহাজটি নৌদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর প্রথমেই তারা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটিকে দেড় দিনের মাথায় সোমালিয়া উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে যায়। দস্যুদের কবলে পড়ার পরদিন বুধবার এটি ছিল সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানে। পরবর্তীতে সেটিকে আরো উত্তর দিকে সরিয়ে প্রথমে নেয়া হয় গারদাকে। এরপরই ভারতীয় নৌবাহিনী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভি ফর আটলান্টা অপারেশন জাহাজটি ঘিরে নজরদারি বাড়ালে সেটি আবারো সরিয়ে নেয়া হয় গদবজিরান উপকূলে। গত তিনদিন ধরে জাহাজটি একই জায়গায় নোঙ্গর করে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারা জানাচ্ছে, জাহাজটি গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/646344