২০ মার্চ ২০২৪, বুধবার, ১০:১৮

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জালজালিয়াতির প্রভাবে কমছে আমানত-ঋণগ্রহীতা

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদারসহ অন্যদের জালজালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ বের করার রেশ কাটছে না। কাটছে না গ্রাহকদের আস্থার সঙ্কট। আর এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে গ্রাহকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট আমানত হিসাব ছিল পাঁচ লাখ ২২ হাজার। গত বছরের ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩১ হাজারে। গত এক বছরের ব্যবধানে আমানতের হিসাব কমেছে ৯১ হাজার বা প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ব্যক্তি আমানতের হিসাব। একই সাথে ঋণের হিসেবধারীর সংখ্যা কমেছে আড়াই শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র নিয়ে প্রতি তিন মাস পর পর রিপোর্ট তৈরি করা হয়। গতকাল সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদন থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক খাতে সুশাসনের সার্বিক উন্নয়ন ঘটলেও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুতর অনিয়মের তথ্য উদঘাটন করেছে, যা আর্থিক খাতের সুশাসনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটি প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান নিজ নামে এবং স্ত্রী, কন্যা, তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যক্তি ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন, যার বর্তমান স্থিতি ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কিছু ঋণ হিসাবকে সিএল বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত না করা, বিরূপ শ্রেণিকৃত ঋণকে অশ্রেণিকৃত হিসেবে দেখানো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অনেক ঋণ হিসাবকে সিআইবিতে রিপোর্ট না করা, বিভিন্ন গ্রাহকের অগোচরে তাদের ঋণ হিসাবের বিপরীতে শ্যাডো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে পরিচালকগণ কর্তৃক অবৈধভাবে অর্থ উত্তোলনের মতো গুরুতর অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়েছে। এমনকি স্বীয় প্রভাব খাটানোর স্বার্থে ওই ব্যক্তি কর্তৃক তার মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট লোকজনের সমন্বয়ে পর্ষদ গঠনের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। এসব অনিয়ম উদ্ঘাটিত হওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছিল। এর প্রভাব এখনো রয়েছে। অনেক গ্রাহকই আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা করছেন; কিন্তু বেশির ভাগই অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।

অপর দিকে ২০১৫ সাল থেকে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় আট হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালকরাই নিয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এতে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের সঙ্কটে পড়ে। তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না। এতে আমানতকারীরা বিক্ষোভ মিছিল মিটিং করেন। এর প্রভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমতে ছিল। কমার সংখ্যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে কমার গতি হ্রাস পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে আমানত হিসাব। আমানতের টাকা ফেরত দিতে না পারায় গ্রাহকরা অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। যে কারণে আমানতের গ্রাহক বেশি কমেছে। ঋণ বা বিনিয়োগের গ্রাহক তুলনামূলক কম কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাব ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার ৩৯২টি। গত বছরের ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ৭০৫টিতে। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ হিসাব কমেছে পাঁচ হাজার ৬৮৭টি বা ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহক কমে যাওয়ার কারণে সঙ্কট বাড়ছে। আমানত আগে কমছিল। এখন বাড়তে শুরু করেছে। তবে বৃদ্ধির হার খুবই কম। একই সাথে নতুন ঋণ বিতরণ খুবই কম। আগের সুদ যোগ হয়ে ঋণ বেড়েছে খুবই সামান্য।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এক বছরে আমানত বেড়েছে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ টাকাবা বৃদ্ধির হার দশমিক ২৪ শতাংশ।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিনিয়োগ ছিল ৭০ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বা বৃদ্ধির হার দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগে আমানত ও ঋণ দুটোই আরো অনেক বেশি হারে বাড়ত। কোনো বছর তা ডাবল ডিজিটের উপরে থাকত।

আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের আমানত বাড়লেও সরকারি খাতের আমানত কমেছে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠ্যানে আমানত জমা না রাখায় সরকারি আমানত কমেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সরকারি আমানত ছিল ৪৯ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি টাকায়। আলোচ্য সময়ে আমানত কমেছে সাত কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের সাড়ে ৯২ শতাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। বাকি ৩ শতাংশ অন্যান্য অঞ্চলে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/822706