১৯ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:৪৫

আত্মহত্যা বাড়ছে অনিশ্চয়তায়

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কবির মতো পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায়। কথায় আছে, সাগরের অথৈই পানিতে পড়লে মানুষ ভাসমান খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। তাহলে দেশের শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণীরা কেন আত্মহত্যার মতো একটি অপরাধ কাণ্ড অবলীলায় ঘটিয়ে ফেলছে? প্রশ্ন হচ্ছে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা কেন আত্মহত্যা করছে? প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাদী মহম্মদ তকীউল্লাহ গত ১৩ মার্চ ইফতার করে ঘরে ঢুকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। দু’দিনের মধ্যে ১৫ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘সুইসাইড নোট’ পোস্ট করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। এর আগে ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডিতে মহসিন খান নামের এক ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় নিজেই পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। গত তিন বছরে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে দেশে কেন বাড়ছে আত্মহত্যা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষণ্নতা থেকে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে চাকরি না পাওয়া, বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে আত্মহত্যা বাড়ছে? গত তিন বছরে কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেছেন তাদের প্রায় সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা। নিশ্চয়ই বেঁচে থাকা ও টিকে থাকতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন?

মনোবিজ্ঞানীরা ও সমাজবিজ্ঞানী মোটা দাগে মনে করেন আত্মহত্যার অনেকগুলো কারণ থাকলেও অন্যতম প্রধান কারণ ‘অনিশ্চয়তা’। হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে যখন মানুষ আর কোনো আশার আলো দেখতে পায় না, তখনই আত্মহত্যা করে। দেশের শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা ‘অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ’ নিয়ে শঙ্কিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জগৎ চেনার-জানার ও প্রত্যাশার চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যখন সেটা মিলছে না তখন শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। গবেষণায় দেখা যায়, দেশে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরবে এজন্য সন্তানদের ওপর ‘প্রেশার কুকারে’র মতো চাপ প্রয়োগ করেন বাবা-মা। কিন্তু প্রত্যাশিত চাকরি না পাওয়া, জীবনের প্রতি হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হওয়ায় সামাজিক লজ্জা, বিয়ের পর যৌতুকের টাকার জোগান দিতে না পারা, চরম দারিদ্রতাসহ নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব না থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা ধৈর্য্য-সহনশীলতা গড়ে না উঠাও আত্মহত্যার জন্য দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। অথচ মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনার খবর পাওয়া যায় না। অথচ হালে উচ্চবিত্তের ছেলে-মেয়েরা মাদরাসায় পড়াশোনা করলেও মাদরাসায় কার্যত নিম্নবিত্ত ও সুবিধা বঞ্চিতরাই পড়েন। তারা চাকরি-বাকরিতেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে সুযোগ কম পান। মাদরাসায় বাংলা-ইংলিশের মতোই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়। এ কারণে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কম।

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর আগের বছর ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৩২ জন। ২০২১ সালে ২,৫৫২ জন শিক্ষার্থীর ওপর একটি জরিপ চালায় আঁচল ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা যায় গ্রাম থেকে পড়তে আসা শতকরা ৮৬ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী বিষণ্নতা আক্রান্ত। শহরে জন্ম নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই হার ৮৪ শতাংশ। কারণ বেকারত্ব, চাকরির জন্য পরিবারের চাপ, আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ, লেখাপড়া শেষে চাকরির অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যত অনিশ্চিত, সংস্কৃতি তথা নৈতিক শিক্ষা না পাওয়ায় অপসংস্কৃতির শ্রোতে গা ভাসানো শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার মানসিকতা তৈরির অন্যতম কারণ। ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। ২০২১ সালের আত্মহত্যা করা ১০১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬২ জনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মোট আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর সালমা আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণত পারিবারিক দুর্দশা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, সম্পর্কের টানাপড়েন ও ক্যারিয়ার নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে থাকে। এছাড়াও মাদকাসক্তি আত্মহত্যার বড় একটা কারণ হিসেবে দেখা যায়। আত্মহত্যার পূর্বে প্রতিটি মানুষই একটা বার্তা দিতে চায় যে, আমার ভালো লাগছে না, মরে গেলেই ভালো হয় ইত্যাদি। এসব যখনই কোনো মানুষের মধ্যে দেখা যাবে, তখনই তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে জীবনের মূল্য কত।

দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে ট্যানেল, অসংখ্য ফ্লাইওভার, উড়াল সড়ক চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন দৃশ্যমান। বিপরীতে এ সময়ে নতুন কর্মসংস্থান তথা নতুন নতুন মিল কারখানা নির্মাণ, শিক্ষিত ছেলে-মেয়ের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে কাজের পরিধি বৃদ্ধি কোনোটিই ঘটেনি; বরং রাষ্ট্রীয় চিনিকল, পাটকল, কাগজকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে কর্মজীবী শ্রমিকদের বেকারত্বের তালিয়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের যে থিউরি তা কর্পেটের নিচে চাপা দিয়ে দৃশ্যমান সেতু-কালভার্ট নির্মাণ হয়েছে। ফলে ডিজিটাল দেশে কয়েক বছরে বেকারত্বের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ২০ হাজার প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় ১০ লাখ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে। ব্যাংকের ৫০ জন জনবল নিয়োগের বিপরীতে ২ লাখ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে। গণমাধ্যমে কোথাও পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেই লাখ লাশ চাকরি প্রার্থী আবেদন করছেন। চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের দেশে শিক্ষিত লাখ লাখ বেকার কাজ না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। যাদের আর্থিক সুবিধা আছে তারা নিজেদের ভবিষ্যত গড়তে বিদেশ চলে যাচ্ছেন। যাদের অর্থের অভাব তারা বেকারত্বের যন্ত্রণায় বিপর্যয়কর অবস্থায় দিন যাপন করছেন। পরিবার তথা বাবা-মায়ের প্রত্যাশা ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে সংসারে হাল ধরবেন; কিন্তু চাকরি না থাকায় যে প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাচ্ছে। ফলে বেকারত্ব, হতাশা, পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ, প্রেমঘটিত জটিলতায় তীব্র বিষন্নতার থেকে শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এছাড়াও স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার শিক্ষা না থাকায় ভোগবাদী মানসিকতা শিক্ষার্থীদের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে সহনশীলতা, সংযমের বদলে তরুণ-তরুণীর চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

দেশে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। একদিকে টাকার পাহাড় অন্যদিকে শুধুই নাই নাই। মানুষের ভোটের অধিকার নেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। চতুর্দিকে নৈতিক অধঃপতন ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা। ভোগবাদী মানসিকতার সমাজ ব্যবস্থা ও নৈতিকতাহীন শিক্ষা মনুষ্যত্বকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে দিচ্ছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে মানুষের অবশ্যই ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে এ সমস্যার সমাধান খোঁজা উচিত। নৈতিকতা ও আদর্শের ভিত শিক্ষার্থীদের মজবুত হলে তাকে আর কোনোভাবেই বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। কারণ মানুষের মনে যখন ধর্ম ও নৈতিক বিকাশ ঘটে তখন যে আপন কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে সুকুমারবৃত্তিকে লালন করতে সক্ষম হয়। সে পাপের পথ ও মত থেকে সত্য ও সুন্দরের পথে হাটতে থাকে। মহানুভবতা, পরোপকারিতা, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা, দয়ামায়া, সংযম প্রভৃতির প্রতি আর্কষিত হয়। অন্যদিকে লোভ, লালসা, অহঙ্কার, মিথ্যা, পরনিন্দা মাথা থেকে দূরিভূত হয়। সে কারণে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী যে হারে আত্মহত্যা করছে; সে হারে মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও তরুণদের আত্মহত্যা করতে দেখা যায় না। মাদরাসায় ধর্মীয় ও নৈতিক বিকাশ ঘটায় সরকারি চাকরি-বাকরিতে কম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও মাদরাসা পড়ুয়া তরুণ-যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায় না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনারারী প্রফেসর ড. এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, যখন কোনো মানুষকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয় এবং সফলতার মাপকাঠি ঠিক করে দেয়া হয়, তখন মানুষ তার ব্যক্তিত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। মানুষ তখন আত্মহত্যাকে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের উপায় হিসেবে মনে করে এবং সে ভাগ্য দ্বারা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বলে মনে করে থাকে। যখন কোনো সমাজে সংহতি থাকে না, মানুষ নিজেকে সমাজের একজন হিসেবে খুঁজে পেতে সমস্যা হয় এবং সে একাকীত্বে ভোগে তখন আত্মহত্যাকে তাদের একাকীত্ব বা অত্যধিক ব্যক্তিত্ব থেকে মুক্ত করার সমাধান হিসেবে বেছে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম রেজাউল করিম বলেন- প্রথমত, প্রেমে প্রতারণার শিকার হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় পছন্দের বিষয় না পাওয়া ও পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশিত ক্যারিয়ার গড়তে ব্যর্থ হয়ে অনেকে এ পথ বেছে নেয়। তৃতীয়ত, এখনকার অনেক ছেলে-মেয়ের সাথে পরিবারের সম্পর্ক ভালো না। পারিবারিক বন্ধনের অভাবে ছেলে-মেয়েরা তাদের সমস্যা শেয়ার করে বাইরের বন্ধুদের সাথে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।

https://dailyinqilab.com/national/article/646111