১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১:১০

ভোটের আগে ঘটা করে উদ্বোধন, চলছে না ট্রেন

সাড়ে চার মাস আগে ঘটা করে উদ্বোধন করা হলেও ভারতের ঋণে (এলওসি) নির্মিত খুলনা-মোংলা রেললাইনে ট্রেন চলছে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিলের আগে কাজ বাকি রেখে প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করা হয়েছিল। ভারতের ঋণে রেলের অন্য চার প্রকল্পের কাজও গতিহীন এবং নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ঋণ পেতে সময় লাগছে।

গত ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকল্প দুটির উদ্বোধন করেন। তবে এলওসি প্রকল্প নিয়ে রেলের সভার নথি অনুযায়ী খুলনা-মোংলা রেলপথের অবশিষ্ট কাজ ভারতের ঠিকাদারকে চলতি মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভারতের ঋণের প্রকল্পবিষয়ক সভায় বলা হয়েছে, ব্যালান্স ট্র্যাক লিঙ্কিংয়ের কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি। ফলে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পে মালপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিল ভারতের ঠিকাদার ইরকনের। প্রকল্পের প্যাকেজ-১-এর ভ্যারিয়েশনের প্রস্তাব রেল মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে।

রেল সচিব হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, ১৫ মার্চের মধ্যে কাজ বুঝিয়ে দেবে ঠিকাদার। এর পর পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে খুলনা-মোংলা রেলপথে। এর পর যাত্রাবাহী ট্রেন চলবে। কবে নাগাদ চলবে, তা স্পষ্ট না করে সচিব জানিয়েছেন, প্রথম পর্যায়ে মোংলা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলবে।

ভারতের ঋণে খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন পায়। পরিকল্পনা ছিল, তিন বছরে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। কিন্তু দু’বার সংশোধন করে প্রকল্প মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা না করে ২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। সেই সময় ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। দুই দফায় বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এতে ভারত ঋণ দিচ্ছে ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যালোচনা অনুযায়ী, ভারতের ঠিকাদারের লারসেন অ্যান্ড টু ব্রো লিমিটেডের সরবরাহ করা স্লিপার ছিল নিম্নমানের। তা বাতিল হওয়া, অনভিজ্ঞ সাব কন্ট্রাক্টর নিয়োগ এবং জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজে দেরি হয়েছে।

আখাউড়া-আগরতলা প্রকল্পে বাংলাদেশ অংশে ১০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণে ৪৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এতে ভারত অনুদান দিয়েছে ৪২১ কোটি টাকা। গত ১ নভেম্বর প্রকল্প উদ্বোধন করা হলেও ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৬ শতাংশ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার গঙ্গাসাগর স্টেশন থেকে ভারতের আগরতলার নিশ্চিন্তপুর স্টেশন পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা তাই উদ্বোধনের সাড়ে চার মাস পরও আলোর মুখ দেখেনি। রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেললাইন মিটারগেজ হওয়ায় ভারতের সঙ্গে আগরতলা রেললাইন দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা সম্ভব নয়। রেল সচিব বলেছেন, পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনায় বাণিজ্যিক চুক্তিসহ আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি বাকি রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেল কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ভোটের কথা মাথায় রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে প্রকল্প দুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। চলতি বছর খুলনা-মোংলা রেলপথে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে। তবে আখাউড়া-আগরতলার ক্ষেত্রে আগামী কয়েক বছরেও এই সম্ভাবনা নেই।

রেল সূত্র জানিয়েছে, ঋণ ছাড়ে গড়িমসি, নানা শর্ত, প্রতিটি ধাপ অনুমোদনে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের জটিলতায় ভারতের ঋণের প্রকল্প এগোয় না। ঋণের শর্তানুযায়ী, ভারতের ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ এবং নির্মাণসামগ্রী কেনার বাধ্যবাধকতাও কাজের গতি শ্লথ করেছে। ভারতকে অনুরোধ এবং তাগদা দিয়েও কাজ হয়নি।

প্রথম ও দ্বিতীয় এলওসিতে ১৬ হাজার ৮১৬ কোটি টাকায় ছয়টি প্রকল্প চলছে রেলে। ভারত ঋণ দেবে ১১ হাজার ৬১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২৭ ফেব্রুয়ারির সভায় কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। ২০১১ সালের জুলাইয়ে অনুমোদিত এ প্রকল্পের ব্যয় ৪৭৭ শতাংশ বেড়েছে। প্রকল্পের অনুমোদনের পর সাড়ে ১২ বছরে কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারির সভায় বলা হয়েছে, প্রকল্পটিতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরামর্শক নেই। তিন দফা সময় বাড়িয়েও পরামর্শক পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ দরকষাকষিতে পরামর্শক হতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান চুক্তি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, টাকার অঙ্ক বাড়াতে দেশটির সরকারের অনুমোদন লাগবে।

প্রায় ১২ বছরে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের ৩৩ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছিল। তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। ভারত ঋণ দেবে ২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। প্রকল্পের কাজে গতি আনতে বাড়তি ২১ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংককে তাগাদা দিয়েছে রেলওয়ে।

এলওসির ঋণে ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রায় ছয় বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ভারত ঋণ দেবে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আগামী জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে। নিশ্চিতভাবেই তাই সময় ও ব্যয় বাড়াতে হবে।

৯৮ কোটি টাকায় সমীক্ষা করতে ভারতের প্রতিষ্ঠান রাইটস ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং আরভি ইন্ডিয়াকে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে ২০২২ সালে সেপ্টেম্বরে। এখনও সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদন, চূড়ান্ত নকশা এবং দরপত্র ডকুমেন্ট তৈরি করেনি পরামর্শক। ১৫ মার্চের মধ্যে তা দিতে তাগিদ দিয়েছে রেলওয়ে। ঋণের ৩০ কোটি ডলার এখনও পাওয়া যায়নি। তা দ্রুত অনুমোদন করতে এক্সিম ব্যাংককে বলেছে রেলওয়ে।

২০১৮ সালে অনুমোদিত ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায় দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়ছে। তবে ১ শতাংশও অগ্রগতি হয়নি ভারতীয় ঋণের এ প্রকল্পে। অর্থাৎ, নির্মাণ শুরু করতেই আরও কয়েক বছর লাগবে। এখনও সমীক্ষা ও নকশা হয়নি। একই অবস্থা ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার খুলনা-দর্শনা ১২৬ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের। এই প্রকল্পের অগ্রগতি সাড়ের ৩ শতাংশ। এ দু্ই প্রকল্পে ভারতের ৪ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা। প্রকল্প অনুমোদনের পর সাড়ে পাঁচ বছরে দেশটি দিয়েছে পৌনে ৮ কোটি টাকা।

https://samakal.com/bangladesh/article/227910