১৬ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১২:৪৯

নূরানি মাদরাসা বাঁচিয়ে রাখতে হবে

-ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

আমাদের দেশে সাধারণ জনগণের মধ্যে সহিহ-শুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম। শতাব্দী ধরে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সনাতন পদ্ধতিতে শিশুদের কুরআন শিক্ষাদানের খেদমত চলে আসছে। সময়ের চাহিদা ও যুগ বিবর্তনের কারণে পুরনো পদ্ধতির সংস্কার ও নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের এক কৃতী পুরুষ মাওলানা কারি বেলায়েত হুসাইন রাহিমাহুল্লাহ (১৯০৭-২০১৭)। ১১০ বছরের শিক্ষা ও শিক্ষকতাজীবনে তিনি সম্যক উপলব্ধি করেন, শিশুমানস ও যুগোপযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআন পঠন-পাঠনের আধুনিক একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করা প্রয়োজন। তিনি এর জন্য প্রাণান্তকর মেহনত করতে থাকেন এবং নানা ফর্মুলা শিক্ষার্থীদের ওপর প্রয়োগ করেন। অবশেষে ষাটের দশকে তিনি গতিশীল একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন, যা ‘নূরানি’ পদ্ধতি নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে।

স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নূরানি পদ্ধতি বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সর্বস্তরের জনগণ বিশেষত কওমি, আলিয়া ও বেরলভি ঘরানার লোকেরা এটি লুফে নেন। সহিহ মাখরাজ মতে, কুরআনের বর্ণমালা উচ্চারণ, তিলাওয়াত এবং ব্ল্যাকবোর্ডের মাধ্যমে পড়া ও লেখার পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। আরবি, বাংলা ও ইংরেজি লেখা, গণিত, সমাজ, পরিবেশ ও শ্রুতিপাঠ, জানাজার নামাজ আদায়ের প্রায়োগিক নিয়ম এবং ৪০টি হাদিস মুখস্থকরণ এই পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই পদ্ধতিতে শিশু শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে একজন শিক্ষার্থী সরাসরি কওমি বা আলিয়া মাদরাসায় অথবা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নূরানি মাদরাসার জন্য বিপুলসংখ্যক শিক্ষক তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা ও জেলায় নূরানি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে ওঠে। স্বতন্ত্র নূরানি শিক্ষাবোর্ড গঠিত হয়।

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ:, মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ:, মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজী হুজুর রহ:-এর মতো মুরব্বি ও বুজুর্গানে দ্বীনের স্নেহছায়া ছিল মাওলানা কারি বেলায়েত হুসাইন সাহেব রহ.-এর ওপর। তাদের সতর্ক তত্ত্বাবধানে তিনি গড়ে ওঠেন এবং শত বছরের জীবনকে বর্ণাঢ্য, কর্মমুখর ও সেবাধর্মী করে তুলতে সক্ষম হন।

নূরানি পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে তিনি একশ্রেণীর মানুষের বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র ছিলেন না। ইখলাস ও নিষ্ঠার কারণে তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। জীবিত থাকতেই তিনি বিস্ময়কর সফলতার মুখ দেখে যেতে সক্ষম হন।

মাওলানা কারি বেলায়েত হুসাইন রহ: আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিক্রমার অপরিহার্য অংশ হয়ে ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। নূরানি পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত লাখ লাখ শিক্ষার্থী তার রূহানি সন্তান হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত করে যাবে। সওয়াবের একটি অংশ তিনি পাবেন। এটি কত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার!

নূরানি পদ্ধতির প্রাথমিক শিক্ষাধারা দেশব্যাপী অভিভাবকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের যা দিতে পারেনি, নূরানি মাদরাসা সেটি দিয়ে গ্রহণযোগ্যতার তুঙ্গে উঠেছে। ফলে অভিভাবকরা নূরানি মাদরাসার দিকে ঝুঁকছেন। এখানে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় রয়েছে। দায়িত্বশীল মহল থেকে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, নূরানি মাদরাসার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নাম থাকলেও পড়ালেখা করছে নূরানি মাদরাসায়। বাস্তবে এর জন্য নূরানি মাদরাসাকে দায়ী করার সুযোগ নেই; বরং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিলেবাসের ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন শিক্ষার্থীদের টানতে পারছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

যত্রতত্র অনুমোদনহীন নূরানি মাদরাসা গড়ে উঠছে, এমন একটি অভিযোগ দায়িত্বশীল মহল থেকে তোলা হচ্ছে। আসলে বেশির ভাগ নূরানি মাদরাসা বেসরকারি নূরানি তালিমুল কুরআন বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সরকার এই বোর্ডকে স্বীকৃতি দিলে ঝামেলা চুকে যায় অথবা জাতীয় সংসদে স্বীকৃত ছয়টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করার পদক্ষেপ নিলে তাও ভালো। অনুমোদনহীন যত্রতত্র গড়ে ওঠা নূরানি মাদরাসাগুলোকে অবশ্য নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। সে জন্য সরকারের সাথে ছয় বোর্ড কর্তৃপক্ষের সংলাপ হতে পারে।

নূরানি তালিমুল কুরআন বোর্ড কর্র্র্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলো পরিবেশবান্ধব, আধুনিক ও সময়োপযোগী। পবিত্র কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পরিবেশ ও সমাজবিজ্ঞানে পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ বাংলাদেশের ফলমূল, পাখি, মাছের পরিচিতি এবং মেঘ, বৃষ্টি ও ঝড় তথা আবহাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, জসিমউদদীন, শেখ ফজলুল করিম, কাজী কাদের নেওয়াজ ও তালিম হোসেনের ছড়া ও কবিতা স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বইতে ‘দেশের তরে লড়ব’ শীর্ষক দেশাত্মবোধক নিবন্ধ রয়েছে। পরিবেশ পরিচিতি বইয়ে ‘আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, ‘আমাদের জাতীয় পতাকা’, ‘জাতীয় প্রতীক’, আমাদের পরিবেশ’ নিয়ে নিবন্ধ রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর ‘নূরানি পরিবেশ পরিচিতি সমাজ’ বইয়ে ‘ছাগল পালন’, ‘আমাদের কৃষি’, ‘বাংলাদেশের সম্পদ’, ‘যানবাহন পথ ও রাস্তা পারাপার’, ‘আমরা সবাই মানুষ’, ‘বাংলাদেশের ঋতু’, বিষয়ে লেখা রয়েছে।

একজন নাগরিকের তার সন্তানকে ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষা দেয়ার অধিকার সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। নূরানি মাদরাসা বা প্রভাতকালীন মক্তব চালু না থাকলে মাদরাসায় শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। নূরানি মাদরাসা হলো দ্বীনী শিক্ষার বীজতলা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে মাদরাসায় ভর্তি হতে গেলে আবার শিক্ষার্থীকে নিচের শ্রেণীতে ভর্তি করাতে হবে। কারণ সে ধর্মীয় শিক্ষা পায়নি। এতে সময়ের অপচয় ঘটবে। অপরপক্ষে নূরানি মাদরাসায় পড়ে যেকোনো শিক্ষার্থী স্কুলে অথবা আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসায় ভর্তি হতে পারবে। নূরানি মাদরাসাপড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরবর্তীতে কওমি মাদরাসায় ভর্তি হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যত শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে সবগুলোর রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলোতে ধর্মশিক্ষা সঙ্কোচনের প্রবণতা স্পষ্ট। এসব কমিশনে একজনও কওমি মাদরাসার প্রতিনিধি ছিলেন না। সদস্য যারা ছিলেন কওমি মাদরাসার শিক্ষাধারা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই অথবা থাকলেও তা খণ্ডিত। কওমি মাদরাসা তো এ দেশের বাস্তবতা। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় ছড়িয়ে আছে শত শত কওমি মাদরাসা। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স কর্তৃক ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ হাজার ২৩০টি কওমি মাদরাসা রয়েছে এবং তাদের ছাত্র সংখ্যা ১৪ লাখ। বেসরকারি হিসাব মতে, ২০২৪ সালে এসে ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা কমিশনে এত বিপুল শিক্ষার্থীর কোনো প্রতিনিধি থাকবে না এটি কী করে হয়? বর্তমান সরকার কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি মূলত প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছে ও উদ্যোগের প্রতিফলন। তখনো সরকারের ভেতর-বাইরে থেকে বিরোধিতা লক্ষ করা গেছে। সরকার ও কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৃতীয় একটি শক্তি সক্রিয়। তৃতীয় শক্তিটি সরকারের বন্ধুবেশি শত্রু, তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে অভ্যস্ত। এ বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

বাংলাদেশে নূরানি ও কওমি মাদ্রাসা সমাজ কর্তৃক পরিচালিত এবং তাদের ভূমিকা গঠনমূলক ও সময়োপযোগী। বিদ্যমান নূরানি ও কওমি মাদরাসাগুলোর মোট ব্যয়ের শতভাগ সমাজের সদস্যরা ব্যক্তিগত অথবা সমষ্টিগতভাবে বহন করে থাকেন। সরকারি কোনো সাহায্য ছাড়াই এসব মাদরাসার অবকাঠামোগত উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং সিলেবাসে আধুনিক বিষয়াদি সংযোজিত হয়েছে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ধর্মপরায়ণ ও অসাম্প্রদায়িক। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্ম শিক্ষার বিদায় অথবা ধর্মশিক্ষা সঙ্কোচন জনগণ কখনো মেনে নেবে না। ধর্মবিবর্জিত ও নাস্তিক্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় ও অকল্যাণ বয়ে আনবে। এ রকম শিক্ষাধারা হবে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ। নূরানি মাদরাসার উপর সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ ধর্মপ্রাণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত শিক্ষাধারা। নূরানি মাদরাসা মূলত পরিচালিত হয় জনগণের সহায়তা, পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে। নূরানি মাদরাসার আদর্শ ও ঐতিহ্য অক্ষুণœ রেখে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নিলে সরকারকে সহযোগিতা করতে উলামা-মাশায়েখরা প্রস্তুত রয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে ধর্মহীন একমুখী শিক্ষানীতি জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/821362