১৪ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২:২২

সরকার পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও মানছে না ব্যবসায়ীরা

বাজারে অস্বস্তি কোনভাবেই কাটছে না। পবিত্র এই রমযান মাসে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে লুটপাটে ব্যস্ত অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। যেকোনো ধর্মীয় উৎসবে বিশ্বের সব দেশে মূল্য ছাড় চললেও একমাত্র বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্যের দাম বেধে দিলেও তা মানছে না ব্যবসায়ীরা। এতে করে বাজারে অস্বিরতা আরও বাড়ছে। ডাল-ভাত দিয়েই ইফতার করতে হচ্ছে নিম্ম আয়ের মানুষকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এদেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, মুনাফাই মূল উদ্দেশ্য। তবে সরকার কঠোর হলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালালেও তাতে কোন ফল হচ্ছে না। ভোক্তারা বলছেন,সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে । তা না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা পকেট কাটায় ব্যস্ত থাকবে। দু এক জনকে সাজা দিলেই তাদের দৌরাত্ম্য কমবে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাতে রোজার আগেই হাজারও পণ্যের দাম কমিয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই খাদ্যপণ্য। আর রোজার অন্যতম অনুসঙ্গ খেজুরের দাম কমিয়েছে ৪০ শতাংশ। ৯ শতাধিক পণ্যের দাম কমিয়েছে কাতার। গেল মঙ্গলবার দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এ ঘোষণা দেয়। পবিত্র রমজান মাসে খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতেই নেওয়া হয়েছে এ উদ্যোগ।
বিশ্বের অন্য মুসলিম দেশগুলোর উল্টো চিত্র শুধু বাংলাদেশেই। কমার পরিবর্তে সব পণ্যের দাম বাড়তি। যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের রোজার বাজার অনেকটাই বেসামাল। ক্রেতারা বলছে, বাজারে সবকিছুর দাম ভয়াবহ। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। রোজায় সব দেশে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে শুধু বাড়ে আর বাড়ে। সরকার চেষ্টা করেও সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না।

এদিকে ইফতারের অন্যতম উপকরণ খেজুরের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক স্মারকে বলা হয়েছে, অতি সাধারণ ও নি¤œমানের খেজুরের দাম কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুরের দাম কেজিপ্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলো।

তবে গতকাল বুধবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এ দামে খেজুর মেলেনি। বরং ২২০ টাকার নিচে কোনো খেজুরই নেই বাজারে। মোটামুটি মানের খেজুর কিনতেও গুনতে হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

অতি সাধারণ ও নি¤œমানের খেজুর হিসেবে বাজারে বাংলা খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। ইরাকের জাইদি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৪০০ টাকা প্রতি কেজি।

সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে কেন বিক্রি করছেন- এমন প্রশ্নে অধিকাংশ বিক্রেতা জানান, তারা দাম বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি জানেন না।

খেজুরের খুচরা মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জারি করা স্মারকে বলা হয়েছে, দেশে আমদানি করা বিভিন্ন মানের খেজুরের আমদানি মূল্য, আরোপিত শুল্ক, কর ও আমদানিকারকদের অন্যান্য খরচ বিশ্লেষণ করে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মূল্যের আলোকে খেজুরের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

রামপুরা বাজারে খেজুর বিক্রি করেন আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, সরকার যদি নির্ধারণ করে দেয়, তবে সরকার সে দামে বিক্রি করুক। আমরা বেশি দামে কিনে কম দামে কীভাবে বিক্রি করবো? নিজের ঘর থেকে এনে দেবো!

এবার রোজা শুরুর বেশ আগে থেকেই বাজারে খেজুরের দাম বাড়তি। কয়েক বছর ধরে খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। গত বছর রোজার আগে আজোয়া ও মেডজুলের মতো দামি খেজুর প্রতি কেজি ৯৫ সেন্ট থেকে এক মার্কিন ডলারে আমদানির ঘোষণা দিয়েছিলেন অনেক ব্যবসায়ী। এই কারণ দেখিয়ে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছিল। শুল্ক-কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আমদানি মূল্যও বেঁধে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি খেজুর আমদানিতে এখন কর দিতে হয় ৬৬ থেকে ২৬৫ টাকা। এরপর এ বছর খেজুরের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

রাজধানী ঢাকার বাজারে উন্নতমানের প্রতি কেজি খেজুর অন্তত এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার সব ধরনের খেজুরের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি। সৌদি মরিয়ম খেজুর ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা, আজোয়া এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সিনিয়র গবেষক ড. মাহফুজ কবির বলছেন, ব্যবসায়ীদের মাঝে সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। তারা সে জায়গায় টাকাও খরচ করে না। তারমধ্যে রমজানে অতিরিক্ত লাভ করে। সেটা থেকেও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, অতিরিক্ত লোভ থেকে দূরে থাকতে আমরা ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করছি। একইসঙ্গে মুক্তবাজার অর্থনীতির অজুহাতে কেউ যেন লাগামহীন মুনাফা করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, এবার শুধু সতর্ক বার্তা নয়, রমজানে কারসাজি করলে শাস্তি পেতে হবে। সরবরাহ ঠিক থাকলেও বাড়তি চাহিদার অজুহাতে প্রতিবছর রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লোটে ব্যবসায়ীরা। ধর্মীয় মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় সংস্থার হুঁশিয়ারি, কোন কিছুই যেন কাজে আসে না।

জহিরুল ইসলাম নামের আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, শুক্রবারে ছুটি থাকে, তাই সপ্তাহের বাজারটা এই দিনে করে ফেলার চেষ্টা করি। কিন্তু এখন দেখছি ব্যবসায়ীরাও এই দিনটাকে ঘিরে নতুন করে ব্যবসার ফন্দি এঁটেছে। বাজারগুলোতে মনিটরিং করতে কোনোদিন দেখিনি। বাজার কমিটিও থাকে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার ধান্দায়। সরকারও যেন সিন্ডিকেটের কাছে অনেকটা অসহায়। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে? এদিকে বিক্রেতারা বলছেন, গত দুই দিন বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির কারণে বাজারে সবজির পরিমাণ কম, তাই বেশি দামেই আমাদের কিনে আনতে হয়েছে।

বিক্রেতা রাকিব মিয়া বলেন, বাজারে শীতের সবজি পর্যাপ্ত আছে, কিন্তু দামটা অন্যান্য সময়ের তুলনামূলক একটু বেশি। আবার দাম বেশি হলেও তুলনামূলক চাহিদাও অনেক বেশি। আপনারা বলছেন দাম বেশি, তারপরও মানুষ এতো পরিমাণ নিচ্ছে, যা দেখে অবাক হওয়ার মতো।

আল-আমিন নামে এক ক্রেতা জানান, বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। রোজার আগে থেকেই সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এখনই বেগুনের কেজি ১০০ টাকা, দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় মধ্য ও নি¤œমধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনী। মানুষ বাধ্য হয়ে ডাল-ভাত দিয়ে ইফতার করছে।

https://www.dailysangram.info/post/551255