১৪ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২:১৯

সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি ২৩ নাবিকের স্বজনরা উৎকণ্ঠায়

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ছিনতাই হওয়ার পর থেকেই শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছেন বাংলাদেশী পতাকাবাহী এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের স্বজনরা। গতকাল বুধবার নাবিকদের স্বজনরা জাহাজটির মালিকপক্ষ এসআর শিপিংয়ের কার্যালয়ে গিয়ে তাদের শঙ্কা আর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।

সোমালিয়ার জলদস্যুরা মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে ভারত মহাসাগরে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামের কয়লাবাহী জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২৩ নাবিককে জিম্মি করে। ১৪ বছর আগে একইভাবে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মণির মত এমভি আবদুল্লাহও বাংলাদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ। বন্দরনগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় কবির গ্রুপের প্রতিষ্ঠানে জড়ো হয়েছিলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের স্বজনরা। সেখানে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর তারা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন; জানান উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কথা।

জাহাজের নাবিক নুর উদ্দীনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, মঙ্গলবার দুপুরে নুর উদ্দীন তাকে ফোন করে জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর জানান। এরপর সন্ধ্যায় ভিডিওকলে কান্নাকাটি করে ছেলেকে দেখতে চান। কান্নাজড়িত কন্ঠে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সন্ধ্যায় লাস্ট দুইটা ভয়েস পাঠিয়েছে। বলছে আমাদের থেকে মোবাইল নিয়ে নেয়া হচ্ছে, আল্লাহর কাছে দোয়া কর। মুক্তিপণ না দেয়া হলে আমাদের একজন একজন করে শুট করা হবে। জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্বে থাকা তানভীর আহামেদের মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে ফোন করে বলেছিল তখনও ইফতার হয়নি। বলেছে- আমাদের কিছুক্ষণ পর নিয়ে যাবে, আমাদের জন্য দোয়া কর। কেমনে আমাদের ছাড়ানো যায় সেটার ব্যবস্থা কর। তারা এখনও পর্যন্ত আমাদের গায়ে হাত তোলেনি’। আমাদের জাহাজে পানি নাই। ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর পানি দেয় কিনা সেটাও জানি না। সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে বসাচ্ছে। গতকাল সকাল ৭টার দিকে নাবিক আইনুল হকের সঙ্গে ফোনে কথা হয় তার মা লুৎফে আরা বেগমের । লুৎফে আরা বেগম বলেন, তার কথা শুনে মনে হয়েছে কোথাও বসে লুকিয়ে লুকিয়ে সে আমাকে ফোন করেছে। সে জানিয়েছে তাদের জাহাজটি সোমালিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরে জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর আইনুল ফোন করে খবর দিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, দুপুর একটার দিকে আমাকে ফোন করে বলেছে- জাহাজে ডাকাত পড়েছে, অফিসে ফোন করে সেটি জানাও। ওইসময় সে খুব কান্না করছিল। জলদস্যুদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, “বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। এখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি। তাদের একটা কৌশল হলো জাহাজ ক্যাপচার করার পর তারা সেফ জোন তৈরি করে। তারপর সেখান থেকে নিজেদের ডিমান্ড জানায়। আমাদের প্রথম প্রায়োরেটি হলো নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় মুক্ত করা। তারপর জাহাজ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা।
২০১০ সালে তাদের এমভি জাহান মণির নাবিকদের ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গ টেনে মিজানুল বলেন, “আমাদের আগের একটি অভিজ্ঞতা আছে। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা এটিও উদ্ধার করতে পারব বলে আশা করছি। মালিকপক্ষ থেকে নাবিকদের স্বজনদের বিচলিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কেএসআরএম অফিসে ভিড় করছেন স্বজনরা: সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক ও ক্রুদের ফিরে পেতে জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের চট্টগ্রাম অফিসে ভিড় করছেন স্বজনরা। এসময় কেএসআরএমের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়, যে কোনো মূল্যে নাবিক ও ক্রুদের সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হবে। ঘটনার পর থেকেই নাবিকদের স্বজনরা কেএসআরএমের অফিসে যোগাযোগ শুরু করেন। গতকাল সকালে অনেকেই চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে কবির গ্রুপের অফিসে আসেন। কবির গ্রুপের অফিসে যারা আসেন তাদের কারও বাবা, কারও সন্তান বা স্বজন জলদস্যুদের হাতে জিম্মি রয়েছেন। এসময় তাদের অনেককেই জিম্মি স্বজনদের ছবি প্রদর্শন করতে দেখা যায়। এমভি আবদুল্লাহর ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের পরিবারও আসে কবির গ্রুপের অফিসে। ছেলে আবদুল্লাহর ছবি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার মা পঞ্চাশোর্ধ্ব জোৎস্না বেগম। তিনি বলেন, সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয়েছে। এরপর থেকে মোবাইল ফোন বন্ধ। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের সন্তানদের ফেরত চাইতে এসেছি। স্বামীর খোঁজে এসেছিলেন জিম্মি নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, অডিও বার্তায় জানিয়েছেন তাদের জাহাজ সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দস্যুরা। জাহাজে তখন অস্ত্রশস্ত্রসহ ৫০ জনের মতো জলদস্যু ছিল। তাদের মুক্ত করতে আমরা যেন মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করি- এই কথা বলেছেন নুরউদ্দিনে।

জাহাজে খাবার আছে ২৫ দিনের: সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’য় ২০ থেকে ২৫ দিনের মতো খাবার আছে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি রয়েছে ২০০ টন। তবে দাহ্য হওয়ায় জাহাজে পরিবহনরত ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খান এক অডিও বার্তায় জাহাজটির মালিকপক্ষ এস আর শিপিং’র কর্মকর্তাদের এসব তথ্য জানিয়েছেন। ভারত মহাসাগরে জলদস্যুরা যখন এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিল, তখন কৌশলে তিনি এই বার্তা পাঠান। আতিকউল্লাহ খান বলেন, ‘প্রক্সিমেটলি ২০–২৫ দিনের প্রোভিশন (রসদ) আছে স্যার। ২০০ মেট্রিক টন ফ্রেস ওয়াটার আছে। আমরা অলরেডি সবাইকে বলছি ফ্রেস ওয়াটার সেফলি ব্যাবহার করতে। প্রোভিসনও (রসদ) আমরা ওভাবে হ্যান্ডেল করবো।’ জাহাজে থাকা ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা প্রবলেম হচ্ছে, আমাদের জাহাজে কোল কার্গো আছে। অ্যাবাউট ফিফটি ফাইভ থাউজ্যান্ডস। এটি একটু ডেইঞ্জারাস কার্গো, এটা হেজার্ড আছে। এটার মিথেন কনসেনট্রেশন বাড়ে। সর্বশেষ অক্সিজেন লেভেল ৯-১০ পার্সেন্ট ছিল। এটা রেগুলার আপডেট নিতে হয়। ইনক্রিজ হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হবে।’ এসময় তিনি কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। ওই অডিও বার্তায় জাহাজে জলদস্যুদের হামলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা)। এই সময় একটা হাই স্পিডবোট (দ্রুতগতির স্পিডবোট) আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আল্যার্ম দেই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা (জলদস্যুরা) চলে এলো।

ফেরত আনতে আমরা বদ্ধপরিকর: সোমালীয় জলসীমায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের নাবিকদের সুস্থ ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতরে ফেরি, স্টিমার, লঞ্চসহ জলযান সুষ্ঠুভাবে চলাচল এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্মপন্থা গ্রহণের বৈঠকের শুরুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন। এখন পর্যন্ত থাকা খবর অনুযায়ী নাবিকরা সুস্থ এবং ভালো আছেন বলেও জানিয়েছেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অপহরণ হওয়া জাহাজ উদ্ধারের অগ্রগতি জানতে চাইলে নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের কথা হচ্ছে যে কোনো মূল্যে নাবিকদের আমরা বাংলাদেশে ফেরত আনতে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা... এটা ভারত মহাসাগরে, বলা হচ্ছে সোমালিয়া থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে জাহাজটি। জলদস্যু কারা এটাই এখনো আইডেন্টিফাইড নয়। ওই অঞ্চলটি সোমালিয়ান অঞ্চল সেটি বলা যেতে পারে। তবে সেটা কে তা (সোমালীয় জলদস্যু) বলা মুশকিল, সেটা আপনি হতে পারেন আমিও হতে পারি।

পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন দিন কাটাচ্ছে- এ বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা সামাজিক জীব, পরিবার নিয়ে বসবাস করি। যে পরিবারগুলোর সদস্যরা সেখানে আটকে আছে, সে পরিবারগুলোর কীভাবে দিন যাচ্ছে সেটা আমরা অনুভব করছি। প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্য জায়গাগুলোতে তিনি কথা বলেছেন। নাবিকদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে কত সময় লাগতে পারে- জানতে চাইলে খালিদ মাহমুদ বলেন, যারা এখন জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা তো মানুষ না তারা জলদস্যু। মানুষের সঙ্গে কথা বললে আমি সময় নির্ধারণ করতে পারবো, এতগুলো মিটিং করলে আমরা শেষ করতে পারবো। এটা জলদস্যুদের বিষয়, জলদস্যু আর মানুষ এক নয়। তাই সময়টা এখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। তিনি বলেন, তবে আমরা বদ্ধপরিকর, আমাদের নাগরিক নাবিকদের আমরা সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে ফেরত আনার ব্যাপারে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং, মেরিটাইম যতগুলো উইং আছে তারা কাজ করছে। সমন্বিতভাবে আমরা এটি নিয়ে আসতে পারবো। আমরা বসে নেই গতকাল বিকেল থেকেই এটা থেকে এক মুহূর্ত বিচ্যুত নই, সবসময় সংযুক্ত আছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমরা এ বিষয়ে অবহিত করেছি। জাহাজটাকে উদ্ধার করার জন্য আমরা সকলের সহযোগিতা চেয়েছি। আমরা প্রথম যে বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা হচ্ছে, জাহাজে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন, সেই ২৩ জন নাবিকের জীবন নিরাপদ রাখা, জীবন রক্ষা করে তাদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসাটা হচ্ছে আমাদের প্রথম কাজ। তিনি বলেন, যেসব জলদস্যু জাহাজটাকে অকুপাইড করে রেখেছে নাবিকদের আটকে রেখেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। নাবিকরা এখনো নিরাপদে আছেন ও সুস্থ আছেন। জাহাজ উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা কীভাবে সহযোগিতা করবে সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক উইংগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। মুক্তিপণ না দিলে জিম্মিদের হত্যা করা হবে বলে জলদস্যুরা হুমকি দিচ্ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমাদের কাছে এই ধরনের সংবাদ এখন পর্যন্ত আসেনি।

সোমালী জলদুস্যুদের হাতে জিম্মি খুলনার তৌফিক ও নেত্রকোনার রোকনের বাড়িতে চলছে আহাজারি
খুলনা ব্যুরো : ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ এর দ্বিতীয় প্রকৌশলী খুলনার মো. তৌফিকুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনা জানার পর থেকে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। পরিবারের দাবি, দ্রুত সবাইকে ভালোভাবে ফিরিয়ে আনার। জিম্মি মো. তৌফিকুল ইসলাম খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানাথীন ২০/১ করিমনগর এলাকার মো. ইকবাল এবং দিল আফরোজা দম্পতির ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট।
বুধবার সকালে তৌফিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার পিতা মো. ইকবাল বিমর্ষ মুখ নিয়ে নিউমার্কেটে তার মোবাইল ফোনের দোকানে যাচ্ছেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কানে আসে কান্নার আওয়াজ। দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন তৌফিকুলের স্ত্রী জোবাইদা নোমান।

জোবাইদা নোমান বলেন, মঙ্গলবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে আমার স্বামী আমাকে ফোন করে দুপুরে তাদেরকে জিম্মি করার কথা জানায়। সে তার পিতা-মাতার সঙ্গেও কথা বলে। তিনি বলেন, আমাদের দাবি দ্রুত যেন আমার স্বামীসহ সকলকে উদ্ধারে সরকার পদক্ষেপ নেয়। আমি আমার স্বামীকে দ্রুত ফিরে পেতে চাই। আমার স্বামী কী অবস্থায় আছে তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছি। ২০০৮ সাল থেকে আমার স্বামী জাহাজে চাকরি করলেও এ ধরনের বিপদে এই প্রথমবার পড়েছে।’

তৌফিকের মাতা দিল আফরোজা বলেন, ‘ছেলেকে জিম্মি করার কথা শোনার পর তাকে কয়েকটি দোয়া পড়ার কথা বলি। তখন সে আমাদের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কথা বলার একপর্যায়ে জলদস্যুরা তার ফোন কেড়ে নেয়। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর কথা বলতে পারিনি। গত ২৫ নবেম্বর সে বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে ওই জাহাজটিতে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। জানি না সে কী অবস্থায় আছে। আমাদের দাবি, শুধু আমার ছেলে না, সবাইকে দ্রুত সুস্থভাবে-ভালোভাবে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে অন্তত স্বস্তিতে থাকতে পারতাম।’ উদ্বেগে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আমার ছেলেসহ ২২ জনকে বন্দী করেছে। সবাইকে যেন সরকার তাড়াতাড়ি তার মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে আনে।

এদিকে তৌফিকের ৭ বছর বয়সী মেয়ে তাসফিয়া তাহসিনা ও ৫ বছর বয়সী ছেলে আহমদ মুসাফি পিতার খবর শুনে মঙ্গলবার বিকেল থেকেই কাঁদছে।

নেত্রকোনা সংবাদদাতা : ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ’র থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে চলছে ছেলেকে ফিরে পাবার আহাজারী।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরুয়া গ্রামের মিরাজ আলী ও লুৎফুন্নাহার দম্পত্তির চার সন্তানের মধ্যে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিন তৃতীয় সন্তান। লেখাপড়া শেষ করে ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিনবাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করেন। গত কয়েকদিন আগে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা বোঝাই করে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি ২৩ জন ক্রু নিয়ে দুবাইয়ের দিকে যাচ্ছিল। জাহাজটি ভারত মহাসাগরে পৌঁছলে সোমালিয়া জলদস্যুর ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। এতে জাহাজের ২৩ জন ক্রু’র মধ্যে থার্ড ইঞ্চিনিয়ার রোকন উদ্দিন আটকা পড়ে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব খবর ছড়িয়ে পড়লে ইঞ্চিনিয়ার রোকন উদ্দিনের গ্রামের বাড়িতে এক ধরণের শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। ছেলের চিন্তায় বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন তার মা লুৎফুন্নাহার, পরিবারের অন্যান্য লোকজনের মধ্যে চলছে আহাজারী। কান্না জড়িত কণ্ঠে মা লুৎফুন্নাহার বলেন, সবশেষে সোমবার ভোর রাতে কথা হয় আমার ছেলের সাথে। গ্রামের ছেলের এমন খবরে হতবাক এলাকাবাসীও। পিতা-মাতাপরিবারের সদস্য সহ এলাকাবাসী সরকারের কাছে অবিলম্বে তাদের ছেলেকে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনতে যা করনীয় তার ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান।

এখন পর্যন্ত আমাদের নাবিকরা নিরাপদে আছে-নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী
জলদস্যুদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা যায়নি
অন্য মাধ্যমে চেষ্টা চলছে-পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও জাহাজের ২৩ নাবিক উদ্ধারে জলদস্যুদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে দ্বিতীয় পক্ষের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রী। এদিকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, সোমালিয়ান দস্যুদের কবলে যে ২৩ জন নাবিক জিম্মি আছে তাদের জীবন রক্ষা করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা আমাদের প্রথম কাজ। আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এটা নিয়ে কাজ করছে। যেসব জলদস্যু জাহাজকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এখন পর্যন্ত তাদের দখলেই আছে। গতকাল বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর ২০২৪ উপলক্ষে ফেরি, স্টিমার, লঞ্চসহ জলযান সুষ্ঠুভাবে চলাচল এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্মপন্থা গ্রহণের লক্ষ্যে এক বৈঠকে এসব কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাহাজটি হাইজ্যাক করা জলদস্যুদের সঙ্গে এখনো ফরমালি যোগাযোগ করা যায়নি। আমরা সেকেন্ড পার্টির মাধ্যমে চেষ্টা করছি এবং যেখানে জানানো প্রয়োজন, সেখানে জানিয়েছি। হাছান মাহমুদ বলেন, এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। বিষয়টি মন্ত্রী সভায়ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে। ড. হাছান বলেন, ইতোমধ্যে রিপোর্টিং সেন্টার ইন কুয়ালালামপুর, ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার ইন নিউ দিল্লি, তারপর সিঙ্গাপুর, ইউএসএ, ইউকে, চীনসহ সব এরিয়ার নেভাল শিপে আমরা রিপোর্ট করেছি। অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমেও আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য জাহাজ এবং নাবিকদের মুক্ত করা। কিন্তু স্ট্র্যাটেজি কী হবে, এটা পাবলিক বলার বিষয় নয়। ইতোপূর্বে একই কোম্পানির একটি জাহাজ জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। তিন মাস পর সেই জাহাজ ও ক্রুদের উদ্ধার করা হয়েছিল। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। জলদস্যুদের কবলে পড়া চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড। জাহাজে ২৩ বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন। এর আগে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর গ্রুপটির জাহাজ এমভি জাহান মনি ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তিন মাসের মাথায় মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়িয়ে এনেছিল কবির গ্রুপ। এছাড়াও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নাবিকদের কত সময়ের মধ্যে ফেরত আনা যাবে, সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ যারা জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তারা তো মানুষ না। মানুষের সঙ্গে কথা বললে আমরা সময় নির্ধারণ করতে পারব। কিন্তু এটা জলদস্যুদের বিষয়। দস্যু আর মানুষ এক জিনিস না। তিনি জানান, সোমালিয়া থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে জাহাজটি আছে। কাজেই সোমালিয়া বলা যাবে না। এটা কারা করেছেন, এই জলদস্যু কারা, তা তো শনাক্ত করা যায় না। তবে ওই অঞ্চলটিকে সোমালীয় অঞ্চল বলা হচ্ছে।

https://www.dailysangram.info/post/551247