১২ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ২:১০

রোজার বাজারে আগুন

আজ থেকে শুরু মাহে রমজান। পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোজার প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কমানো হলেও বাংলাদেশে দেখা যায় এর বিপরীত চিত্র। নিত্যপণ্যের দাম কমার পরিবর্তে রমজান উপলক্ষে আরও বাড়ছে। সরকারের নানান হাঁকডাকেও কোন কাজ হচ্ছে না। উল্টো সপ্তাহের ব্যবধানে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ রমজানে প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ইফতারের সময় শরবতে ব্যবহৃত লেবু ও ইসুবগুলের ভুসির দামও কেজিতে বেড়েছে ৫০০টাকা। যে লেবুর হালি এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা তার দাম গতকাল হয়েছে দ্বিগুণ। অর্থাৎ ৬০ থেকে ৮০ টাকা হালি। ইফতারে ডালের বড়া বা বেগুনি তৈরিতে যে বেসন ব্যবহার করা হয় তার দামও সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। গরুর গোশত এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৭০০ টাকা থেকে ৭২০ টাকা কেজি। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে তা ৭৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। সরকার সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার (বোতলজাত) ১৬৩ টাকা নির্ধারণ করেছে। যা গত ১ মার্চ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও কার্যকর হয়নি। গতকাল বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রোজার ১ মাস আগে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল নিত্যপণ্যের দাম। তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর রমজানের প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতাদের একবারে নাভিশ্বাস অবস্থা। এ অবস্থায় সরকারও এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ব্যবসায়ীদের সাথে বারবার বৈঠক করে সরকার। এরপর রমজানে কোন পণ্যের দাম বাড়বে না বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কোন প্রতিফলনই ঘটেনি। রোজার আগের দিন অর্থাৎ গতকালও বাজারে সব পণ্যের দামই গত সপ্তাহের চেয়ে বেশি। আর এটা ক্রেতাদের জন্য ‘বোঝার উপর শাকের আটি’র অবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেকে বলছেন সরকারের সাথে জড়িত লোকজনই পণ্যের দাম ইচ্ছামত বাড়াচ্ছে। তাই সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, বা তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবেন এমনটাও বিশ্বাস যোগ্য নয়।

বাজার বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এ সরকার নিত্যপণ্যের দাম কমাবে এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। কেননা এধরনের সরকার অর্থাৎ ভোটারবিহীন সরকার অলিগার্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে তারা সরকারের কাছের লোক। সরকার তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নেয়। তাই সরকারই তাদেরকে বেশি মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। জনগণ তাদের প্রয়োজন নেই। জনগণের কষ্টের কথা সরকারের ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। তাই সরকার বাজারে পণ্যের দাম কমানোর যে কথা বলে সেটা আইওয়াশ মাত্র। এটা জনগণকে ধোঁকা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এমনটি মনে করেন না। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার চেষ্টা করছে। আসলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, মূল্যস্ফীতি ও আমদানি শুল্কের কারণে দাম বেড়েছে। গত দুই বছরে টাকার মান কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ, যা দেশের জন্য আমদানি ব্যয়বহুল করে তুলেছে। ডলার সঙ্কট যদি থাকে তাহলে আমদানি করা পণ্যের দাম চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ সন্ধানিরা পণ্যের দাম কারসাজি করে বাড়াচ্ছে। সরকার সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

রোজায় প্রয়োজন এমন পণ্য কিনতে গতকালও ক্রেতাদের ব্যস্ত দেখা গেছে। কিন্তু এসব পণ্যের বাজারে কোনো সুখবর নেই। ক্রেতাদের সবকিছুই চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। রোজার বাজারে নতুন করে বেড়েছে গরুর গোশত ও মুরগির দাম। খুচরায় তেল, চিনি, বেসন ও ছোলার দামও বেড়েছে। ইফতারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন সবজি যেমন পেঁয়াজ, আলু ও বেগুনের দামও বাড়তির দিকে। পেঁয়াজ গত সপ্তাহে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও গতকাল তা ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। আলু এক সপ্তাহ আগে ২৮ থেকে ৩০ টাকা কেজি ছিল গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা কেজি। ৫০-৬০ টাকা কেজির বেগুন এক সপ্তাহে বেড়ে হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। লাফিয়ে বাড়ছে লেবুর দামও। আকার ভেদে হালি প্রতি লেবুর দাম উঠেছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। গত সপ্তাহে যা ছিল ২০ থেকে ৩০ টাকা। ঢাকায় গরুর গোশতের দাম বেড়েছে। গরুর গোশত ৭২০ টাকা থেকে বেড়ে কেজি প্রতি ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। রমজান এলেই বাজারে চাহিদা বাড়ে ইসুবগুলের ভুসির। ইফতারে এই পানীয় দিয়ে রোজা ভাঙতে পছন্দ করেন রোজাদাররা। তবে এবার রোজার আগেই প্রতিনিয়ত দাম বেড়েছে শরবতে ব্যবহৃত ইসুবগুলের ভুসির। বিক্রেতারা বলছেন, গত রমজানের পর থেকেই একটু একটু করে প্রতিনিয়ত দাম বেড়েছে ইসুবগুলের ভুসির। গত ৬ মাসের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে শরবতে ব্যবহৃত এই পণ্যটির দাম কেজিতে প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তারা আমদানি খরচ বৃদ্ধি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো, ডলার সংকটে সরবরাহ ঘাটতির কথা বলছেন।

গতকাল রাজধানীর মালিবাগ, শান্তি নগর, খিলগাঁও কাঁচাবাজার ও হাতিরপুল বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারিতে চিনির দাম নতুন করে কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে বেড়েছে পাঁচ টাকা। খুচরায় কেজিপ্রতি চিনির দাম (প্যাকেটজাত) ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। গত সপ্তাহেও ছিল ১৫৫ টাকা কেজি। ব্যবসায়ীরা বলছেন চট্টগ্রামে চিনির একটি গুদামে আগুন লাগার পরে দাম নতুন করে বেড়েছে। তবে বাজারে বড় কোনো সংকট তৈরি হবে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

শান্তি নগরের আরিফ স্টোরের স্বত্বাধিকারী আরিফের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান চিনির দাম পাইকারিতে কিছুটা বেড়েছে। তবে বাজারে সরবরাহের সংকট নেই, তাই দাম আর বাড়ার আশঙ্কা কম।

এছাড়া ছোলা ও কয়েক পদের ডালের দামও বাড়তি দেখা গেছে। ভালো মানের ছোলার দাম নতুন করে কেজিতে দুই থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে। আর অ্যাংকর ও খেসারি ডালের দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকার মতো। অ্যাংকর ডাল খুচরায় কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ও খেসারির ডাল মানভেদে ১১৫ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগের সপ্তাহে কিছুটা কম ছিল।

রোজার বাজারে বিক্রেতাদের বেশ ব্যস্ত দেখা গেলেও ক্রেতাদের অনেকের চেহারায় ছিল চিন্তার ছাপ। রোজায় বেশি প্রয়োজন এমন অধিকাংশ পণ্য বেশ চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি কিনতে হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। আর ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে সোনালি মুরগি। সোনালি মুরগির দাম কোথাও কোথাও সাড়ে ৩০০ টাকাও চাওয়া হচ্ছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। এদিকে বাজারে নতুন দামের সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের বোতল এলেও এখনো এক ও দুই লিটারের বোতল পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে অনেক খুচরা ব্যবসায়ী নির্ধারিত দর লিটারে ১৬৩ টাকার চেয়ে বেশি রাখছেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/644578