৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৩:০৯

বড় অগ্নিকাণ্ডের সব মামলা হিমঘরে

২০২২ সালের ৪ঠা জুন রাতটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডবাসীর জীবনে ভয়াল আতঙ্কের এক রাত। ওই রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় ৫১টি তাজা প্রাণ। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন ফায়ার ফাইটারও নিহত হন। আহত হন আরও অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। মর্মান্তিক ওই ঘটনার এক মাস পরেও ঘটনাস্থল থেকে মানুষের পোড়া হাড় উদ্ধার করা হয়। হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনাটি পুরো দেশকে শোকাহত করেছিল। তখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। বিস্ফোরণের তিনদিন পর ৭ই জুন রাতে সীতাকুণ্ড থানার দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় একটি মামলা করেন এসআই আশরাফ সিদ্দিকী। মামলায় আসামি করা হয় ডিপোর ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আকতার, ম্যানেজার (এডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী এডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) আবদুল আজিজ, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, একই বিভাগের নজরুল ইসলাম ও জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খানকে।

কিন্তু পুলিশ দীর্ঘদিন তদন্ত করে ডিপো কর্তৃপক্ষের কোনো দায় খুঁজে না পেয়ে গত বছরের মে মাসে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদন আদালতও গ্রহণ করেন। এতে করে বিএম ডিপোর যে ৮ কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা হয়েছিল সেই মামলা থেকে তারা সবাই অব্যাহতি পেয়েছেন। অথচ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না।

শুধু সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনারের ওই ঘটনার মামলায় নয়। বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের শত শত মানুষের মৃত্যুর পরও দোষীদের কেউ শাস্তি পায়নি। বড় কোনো মামলার রায়ও হয়নি। কিছু মামলা এখনও চলমান। কিছু মামলা থেকে আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। কিছু মামলা এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। বলতে গেলে বড় ঘটনার প্রায় সব মামলাই হিমঘরে রয়েছে। প্রায় ১৪ বছর আগে ২০১০ সালের ৩রা জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরার ৪৩ নম্বর বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সৃষ্ট আগুন মুহূর্তেই আধাকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কেমিক্যালের কারণে আগুন দ্রুত আশপাশের সব বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ ওই আগুনে নারী-শিশুসহ ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। এক পরিবারেরই মারা যায় ১১ জন। আরও কিছু পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্য হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। অনেক বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। অনেকে পথে বসেন। সে সময় ঘটনা তদন্তে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশ। আজও সেই জিডি’র তদন্ত শেষ হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘটনায় সরকার একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। তখন ওই কমিটির সঙ্গে পুলিশের তদন্ত সমন্বয় করা হয়েছিল। বংশাল থানায় সূত্রে জানা গেছে, আগুনের ঘটনায় করা সেই জিডি’র কপি এখন থানার নথিতে আছে। তবে জিডি’র বিষয়ে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখনো ভুলে যায়নি মানুষ। ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর ভয়াল অগ্নিকাণ্ডে তাজরিন ফ্যাশনের ১১২ শ্রমিক মারা যান। মর্মান্তিক এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা হয়। ২০১৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের পরিদর্শক একেএম মহসিন উজ্জামান খান তাজরিন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ার হোসেন, মাহমুদা আক্তার ও ১১ কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। ২০১৫ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর আদালত ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এই মামলায় ১০৪ সাক্ষীর মধ্যে ১১ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সর্বশেষ সাক্ষীর জবানবন্দি ২০২২ সালের ১৮ই মে রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর আর কোনো সাক্ষী আদালতে আসেননি। কারখানা মালিক দেলোয়ারকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হলেও এখন তিনি জামিনে আছেন।

২০১৯ সালের ২৮শে মার্চ এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ জনের প্রাণহানি হয়। ঘটনার দু’দিন পর বনানী থানায় মামলা করে পুলিশ। মামলার তদন্ত পরে চলে যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। সংস্থটি গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে। কিন্তু এই মামলারও বিচার এখনও শুরু হয়নি। এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের মাসখানের আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৭১ জন নিহত হন। একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের একটি ট্রান্সমিটারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার একদিন পর ওই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তের তিন বছর পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আবদুল কাইয়ুমও ২০২২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক হাসান সুলতান ও তার ভাই হোসেন সুলতান সোহেলসহ আটজনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন। এর এক বছর পর ২০২৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। নয় মাসের ব্যবধানে গত বছরের ১৭ই অক্টোবর মামলার অভিযোগকারী আসিফের সাক্ষ্য রেকর্ড করেন আদালত। মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে আগামী ২১শে মার্চ। এই মামলায় মোট ১৬৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ১৮ই জুলাই নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুতে দায়ের করা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গত বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর দাখিল করে সিআইডি। অভিযোগপত্র থেকে হাসেম ফুডসের পরিচালকদের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। মামলার শুনানি এখনো শুরু হয়নি। ২০২১ সালের ২৭শে জুন ঢাকার মগবাজার এলাকায় গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ হয়ে ৭ জন মারা যান। এছাড়া গত বছরের ৮ই মার্চ রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে একটি সাততলা ভবনের বেজমেন্ট ক্যাফেতে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ২৫ জন নিহত এবং প্রায় ১০০ জন আহত হন। দু’টি ঘটনার মামলার তদন্ত করছে ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। কিন্তু দু’টি মামলার তদন্ত এখনও চলছে। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, দু’টি মামলারই তদন্ত চলছে। মগবাজারের মামলার তদন্ত চলতি মাসে জমা দেয়া হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মানবজমিনকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, কারখানা পরিদর্শক, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু এসব দপ্তর থেকে একবার অনুমোদন নিলে পরে আর খবর থাকে না। পরে আর কাজের কাজ কিছুই হয় না। গার্মেন্টেসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা দেখেছি তাদের পরিদর্শক কম থাকার অজুহাত দেয়া হয়েছে। পরে ফ্যাক্টরি পরিদর্শক নিয়োগ দিয়ে বাড়ানো হয়। এখন কেউ যদি বলে লোকবল কম হওয়ার কারণে দায়িত্ব পালন করতে পারছি না সেটা কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হতে পারে না। অথচ কখনও কোনো পরিদর্শকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আর জেলে গেছেন- এমন শোনা যাবে না। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর উচ্চপদস্থ কাউকে জবাবদিহি করতে হয়েছে এমনও শোনা যাবে না। কিন্তু তাদেরকে আগে ধরতে হবে। তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। এর পাশাপাশি যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে দায়িত্বে অবহেলা করে মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। কিন্তু ওইসব ভবনে সরকারি যেসব সংস্থার দায়িত্ব পালন করার কথা তারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করে ছাড়পত্র দিয়েছে। তিনি বলেন, হাসেম ফুডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাগরিক কমিটি হয়েছে। আমি সেটার আহ্বায়ক ছিলাম। আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে শ্রম মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। অথচ হাশেম ফুডের যাদের নামে মামলা হয়েছে প্রত্যেকেই খালাস পেয়ে গেছে। তাজরিন গার্মেন্টসের ক্ষেত্রেও মালিকের জামিন হয়েছে। কোনো ঘটনায় কাউকে সিরিয়ায় আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি।

তিনি বলেন, এখানে মূল বিষয় হচ্ছে- যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কিনা? যাদের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর কথা তাদের বেশির ভাগই ধনবান, ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা। তাই যে সকল প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা তারাই এসব প্রভাবশালীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে।

সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মানবজমিনকে বলেন, অব্যবস্থাপনা এবং আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে বিচার হয় না। বেইলি রোডের ঘটনায় এখন সবকিছু সজাগ হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রেস্টুরেন্টও ভেঙে দিচ্ছে। এক সপ্তাহ পর আর খবরও থাকবে না। এটাই আমাদের প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য। হুজুগে একটা কাজ করে পরে আর খবর থাকে না। নীতি-নির্ধারকদের যে কাজটা করার কথা তারা যদি সেটা করতো তবে এ রকম হতো না। যত সময় প্রশাসন-রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন না হবে, আইনের শাসনে ফিরে না যাবো ততদিন পর্যন্ত কোনো কিছুই হবে না। মামলা, তদন্ত আলোর মুখ দেখে না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কোনো সিস্টেম নাই। এখানে যার যে ক্ষমতা আছে সেটি প্রয়োগ করে যদি রেহাই পেয়ে যায় তবে বাধা দেয়ার কেউ নাই। প্রশাসন বাধা দেয়ার সাহস-সক্ষমতা নাই। রেস্টুরেন্ট যারা করে তারা প্রভাবশালী। এখানে জোর যার মুল্লুক তার। এজন্য দুর্ঘটনাও ঘটবে কিন্তু কোনো বিচার হবে না। অনেক ঘটনায় অনেক মানুষ মারা গেছে অথচ কিছুই হয়নি। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থা সঠিক পদ্ধতিতে থাকতে হয়। রাষ্ট্রকে আইনের শাসনের জন্য দৃঢ় থাকতে হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=100351