৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ২:৫৬

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের করণীয়

-প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব

একটি সমাজ ও সভ্যতার মূল্যবোধ প্রজন্মের পর প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষাব্যবস্থাই নির্ধারণ করে ভবিষ্যতে দেশে কী ধরনের নাগরিক তৈরি হবে। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য কেবল কর্মদক্ষ নাগরিক তৈরি নয়। কেননা রাষ্ট্রের কল্যাণ কেবল বস্তুগত উন্নতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষা ও মানবিকতার বিকাশে নৈতিকতার বিষয়টিও জরুরি। কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘শিক্ষাক্রম’ হলো একটি আয়নাস্বরূপ যার মধ্যে সে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি বিনির্মাণে অত্যন্ত জরুরি। এজন্য একটি নিখুঁত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের কাজটি সে দেশের নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ৯টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও কোনটির সুপারিশকৃত শিক্ষানীতিতেই গণমানুষের কৃষ্টি-কালচার, জীবনবোধ ও দর্শনের প্রতিফলন ঘটেনি। গত বছর থেকে নতুন যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে তা নিয়ে নানা মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে সাজানো হয়েছে এ শিক্ষাক্রম। ৯০ শতাংশের অধিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর এ দেশে যে ধরনের শিক্ষানীতি বা শিক্ষাক্রম হওয়ার কথা ছিল ব্রিটিশ ভারত থেকেই তা চরম অবহেলার শিকার। কেবল ১৯৭১ সালের পর প্রণীত বাংলাদেশের সব শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নামকাওয়াস্তে কিছু ধর্মীয় পাঠ্যবই রাখা হলেও অবহেলা ছিল সেখানেও। উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো কাঠামো না থাকায় দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ও কর্মদক্ষ জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে নৈতিকতার সঙ্কট। যুগের পর যুগ পার হচ্ছে কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার কোনো পরিমার্জন হচ্ছে না। বরং আধুনিকায়নের নামে মাদরাসা শিক্ষার মৌলিকত্ব নষ্ট করে স্কুলের সিলেবাস মাদরাসার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যত সময় যাচ্ছে শিক্ষিতের হার এবং মাথা পিছু আয় বাড়ছে; বাড়ছে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা; কিন্তু এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে যাবতীয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডও। অথচ শিক্ষার উন্নয়নের সাথে সাথে এসব নি¤œগামী হওয়ার কথা ছিল। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ায় সঙ্কট রয়েছে। এ সঙ্কটেরস্বরূপ উদঘাটন ও তার নিরসন করা প্রয়োজন।

শিক্ষাব্যবস্থা : তত্ত্ব ও ইতিহাস
শিক্ষাব্যবস্থা বলতে শিক্ষা সংস্থানকে সুসংগঠিত করার প্যাটার্ন বোঝায়, যা সাধারণত জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত হয়। মূলত জাতীয় পর্যায়ই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর শিক্ষানীতি বলতে সেসব নীতিমালার সমষ্টি বোঝায়, যার উপর ভিত্তি করে এই সংগঠনের কাজ করা যায়, যার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষাসংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রত্যাশা করা হয়।

কোনো রাষ্ট্র কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি নির্ধারণ করবে তা নির্ভর করে ওই রাষ্ট্রের শিক্ষার শিক্ষাসম্পর্কিত ধারণার ওপর। এ ধারণাগুলোর মধ্যে আছে শিক্ষার প্রকৃতি, শিক্ষার উৎস, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য ইত্যাদি।

প্রাচীন মিসরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতায় শিক্ষা মূলত ধর্মীয় যাজকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত ও জ্যামিতির মতো ব্যবহারিক বিষয়গুলো যাজকরাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দিতেন। অন্য দিকে স্থাপত্যবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ও ভাস্কর্যশিল্পের মতো পেশামূলক বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষা দেয়া হতো। শিক্ষা মূলত সমাজের প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। পুনরাবৃত্তি ও মুখস্থকরণ ছিল শিক্ষার প্রাথমিক পদ্ধতি। তবে গ্রিক সভ্যতায় ছেলেরা ৭ বছর বয়সে বিদ্যালয়ে যেত যেখানে তারা পড়া, লেখা, গণিতের পাশাপাশি কাব্য ও সঙ্গীতও শিখত। মেয়েরা ঘরে পড়তে ও লিখতে শিখত। এ ছাড়াও মায়েদের থেকে সেলাই, রন্ধন ইত্যাদি ব্যবহারিক বিদ্যা শিখত। স্পার্টায় ছেলেদের সাত বছর বয়সেই সামরিক ব্যারাকে পাঠিয়ে দেয়া হতো যুদ্ধবিদ্যা শেখানোর জন্য। শারীরিক কসরত ছিল শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। রোমান সভ্যতায় ধনী পরিবারের সন্তানদের ঘরে শিক্ষক রেখে শিক্ষাদান করা হতো। অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা সাত বছর বয়সে বিদ্যালয়ে যেত যেখানে তারা প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে পড়তে, লিখতে ও সাধারণ হিসেব করতে শিখত। ছেলেরা আরো উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করত যে পর্যায়ে তাদের জ্যামিতি, ইতিহাস, সাহিত্য এবং বক্তৃতা শেখানো হতো। গ্রিক ও রোমান শিক্ষাব্যবস্থায় জনপরিসরে অংশগ্রহণ এবং নাগরিক দায়িত্বের ওপর জোর দেয়া হতো।

খ্রিষ্টীয় ইউরোপে মধ্যযুগে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ক্যাথলিক চার্চের সাথে সংশ্লিষ্ট। এসব প্রতিষ্ঠানে খ্রিষ্টধর্মীয় শাস্ত্র ছাড়াও ব্যাপক পরিসরে ত্রয়ী বিষয় (trivium) তথা ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যা এবং ক্ষুদ্র পরিসরে চতুষ্টয়ী বিষয় (quadrivium) তথা গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সঙ্গীত শেখানো হতো। শিক্ষার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন ভাষা।

এনলাইটেনমেন্ট যুগের পর থেকে পাশ্চাত্যে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর খ্রিষ্টধর্মীয় প্রভাব দুর্বল হতে থাকে। বাইবেলের প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে, ফলে খ্রিষ্টধর্মীয়ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে মূলধারা থেকে প্রতিস্থাপিত হয় সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মের প্রভাবমুক্ত মানব যুক্তি ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানভিত্তিক বলে দাবি করা হতো। মূলত ক্যাথলিক ও প্রটেস্টট্যান্ট খ্রিষ্টানদের মধ্যে চলা রক্তক্ষয়ী ৩০ বছরব্যাপী (১৬১০-১৬৪৮) যুদ্ধের পর ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব হ্রাস পায় এবং জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে। এ সময়কালে বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রচলিত গণশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রমিত ভাষায় শিক্ষাদানের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত বিভিন্ন সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক জাতির মানুষকে আত্মীকরণ (assimilation) এবং একজাতকরণ (homogenization) করে জাতিরাষ্ট্রের অনুগত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাবিদ জন লক এবং থমাস হবস এসময়কালেই ক্যাথলিক চার্চের প্রতি আনুগত্যের বদলে জাতিরাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেন। আধুনিক স্কুলশিক্ষা মূলত জাতিরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক উন্নয়নের দায়িত্ব নেয়। শিল্প বিপ্লবের সময় পাশ্চাত্যে শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা : কুরআন নাজিলের মাধ্যমেই ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। কুরআনের প্রথম নির্দেশ ছিল ‘পড়ো!’ কুরআনের এই নির্দেশনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিমরা জ্ঞানভিত্তিক এক অতুলনীয় সভ্যতা গড়ে তোলে। ইসলামের পরিভাষায়, ‘ইলম’ তথা জ্ঞান কেবল তথ্য-উপাত্তের নাম নয়, যা কেবল সমাজ ও মানুষের উপযোগিতায় ব্যবহারযোগ্য। বরং জ্ঞান হচ্ছে এমন জিনিস যা মানুষকে তার অস্তিত্বের উৎস ও উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত করে এবং বাকি সৃষ্টিজগতের সাথে তাকে ঐকতানে নিয়ে আসে। ইসলামের শিক্ষাব্যবস্থার মূলে রয়েছে তিনটি ধারণা : ‘তালিম’ যার অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু জানানো, শেখানো এবং সে ব্যাপারে অবগত করে তোলা; ‘তারবিয়াহ’ যার অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুকে বৃদ্ধি বা বিকশিত করা এবং ‘তাদিব’ যার অর্থ হচ্ছে কাউকে মার্জিত ও আচারনিষ্ঠ করে তোলা। মুসলিম সভ্যতায় প্রথমে মসজিদ এবং এরপর মাদরাসার মাধ্যমে গণপরিসরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম শাসনাধীন স্পেনের কর্ডোভায় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৭০টি পাবলিক লাইব্রেরি ছিল। ১৪শ’ এবং ১৫শ’ শতাব্দীর মুসলিম শাসনাধীন দিল্লিতে প্রায় এক হাজারের মতো মাদরাসা ছিল এবং সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত ছিল। ১৮শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা কায়রোতে শিক্ষার উচ্চ হার দেখে অবাক হয়ে যায়। আলজেরিয়া দখলকারী ফ্রেঞ্চ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট ফ্রেঞ্চ গবেষকগণ লক্ষ করেন যে, ফ্রেঞ্চ দখলদারিত্বের শুরুর দিকে আলজেরিয়ায় শিক্ষার হার ফ্রান্সের শিক্ষার হারের চেয়েও বেশি। মাদরাসাগুলোতে দুই ধরনের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া হতো : উলুম আল মা’স্কুল (মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) এবং উলুম আল মানকুল (ধর্মশাস্ত্র সংক্রান্ত জ্ঞান)। উলুম আল মা’স্কুল-এর উদাহরণ ছিল গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, স্থাপত্যবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি; আর উলুম আল মানকুল-এর উদাহরণ হচ্ছে উলুম আল কুরআন, উলুম আল হাদিস, ফিকহ, উসুলে ফিকহ ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, এই বিভাজন ধর্মীয়/সেক্যুলারভিত্তিক বিভাজন ছিল না। উভয় প্রকার জ্ঞানকেই ইসলামী কাঠামোর মধ্যেই শিক্ষা দেয়া হতো।

পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতি
পশ্চিমা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তি ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নিজেকে নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন দাবি করলেও তা বিভিন্ন দার্শনিক প্যারাডাইম যেমন দৃষ্টবাদ (positivism), খণ্ডবাদ (reductionism), আপেক্ষিকতাবাদ (relativism) কিংবা ঐতিহাসিকতাবাদ (historicism)-এর উপর ভিত্তি করে রচিত। মূলত জ্ঞানমাত্রই কোনো না কোনো বিশ্বদর্শনের আলোকেই বিশ্লেষণ করতে হয়। মূলত জ্ঞানের সাথে আল্লাহ ও অহির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে একে প্রকৃতিবাদের উপর স্থাপন করার ফলে পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান হয়ে পড়েছে খণ্ডবাদী (reductionist), যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো ইন্দ্রীয়বোধ্যতা (perceptibility), পরিমাপযোগ্যতা (quantifiability) ও বস্তুগতকে (materialism)-কে অতিন্দ্রীয়তা (imperceptibility), গুণ (quality) ও অপরিমাপযোগ্যতার (immeasurability) ওপর ব্যাপকভাবে প্রাধান্য দেয়া।

প্রচলিত পশ্চিমা ধাঁচের সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় দিক হলো ‘সামাজিক প্রকোষ্ঠকরণ’ (social compartmentalization) তৈরি করা। দার্শনিক এলাসডেয়ার ম্যাকইন্টায়ারের ভাষায়, সামাজিক প্রকোষ্ঠকরণ হচ্ছে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র স্ব স্ব যুক্তিসিদ্ধতা, নিয়ম ও বিহিত ভূমিকা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়ে পড়া। তাই একজন মানুষ যখন ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র যৌক্তিক ও নৈতিক নমুনার মধ্যে কাজ করে। এর ফলে একক মানবিক সত্তা হিসেবে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার ভাবনা ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয়, তার মধ্যে তৈরি হয় মানসিক টানাপড়েন ও অস্থিরতা।

ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে পশ্চিমা মানুষের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে অন্য সেক্যুলার দর্শনের উপর। হালজমানার এই সেক্যুলার দর্শন হচ্ছে লিবারেলিজম বা উদারতাবাদ। লিবারেলিজমের প্রধান দিক হচ্ছে সামষ্টিকতার উপর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রাধান্য দেয়া। লিবারেল নৈতিকতার মূলে রয়েছে Harm principle বা ‘ক্ষতির নীতি’ যা এর প্রবক্তা লিবারেলিজমের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন : ‘the only purpose for which power can rightfully be exercised over any member of a civilised community against his will is to prevent harm to others.’ অর্থাৎ ‘কোনো সভ্য সমাজের একজন সদস্যের উপর (রাষ্ট্রীয়) ক্ষমতাকে কেবল তখনই ন্যায্যভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে যখন তা দ্বারা তাকে সমাজের অন্য সদস্যকে ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখা হয়।’ ধর্মীয় শিক্ষা না থাকার ফলে মানুষ পরিবার ও সমাজের বাধন থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা। এই আত্মকেন্দ্রিকতার পরিপূরক হিসেবে দেখা দিচ্ছে ভোগবাদিতা। মূলত এ দুটো পরস্পরের পরিপূরক। ধর্মীয় বাধা দূর হয়ে যাওয়ার কারণে যৌনতার উপর বিধি-নিষেধও উঠে যাচ্ছে। এর ফলে বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে যৌন বিশৃঙ্খলা। বিয়েবহির্ভূত অবাধ যৌন সম্পর্ককে এখন পাশ্চাত্যে খুবই স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয়। ফলে বিয়ের কাঠামোর বাইরে জন্ম নিচ্ছে বহু শিশু, যারা পিতার সাহচর্য ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এসব শিশু বড় হয় ড্রাগ এডিকশন ও রাহাজানির মতো অপরাধ ও আইনবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

দীর্ঘসময় এই সেক্যুলার পশ্চিমা শক্তি নিজেদের জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মাতাল হয়ে পরিবেশকে ¯্রফে নিজেদের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। অন্য ধর্মকেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাদী সভ্যতাগুলোতে বিশেষ করে ইব্রাহীমিয় ধর্মগুলোতে (ইহুদিবাদ, খ্রিষ্টবাদ ও ইসলাম) প্রকৃতিকে কেবল ব্যবহারযোগ্য জিনিস নয় বরং খোদার নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হতো। তাই প্রকৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশ ছিল সব ঐতিহ্যবাদী সভ্যতার নৈতিকতার একটি বড় অংশ। কিন্তু সেক্যুলার পশ্চিমা বিশ্ব প্রকৃতিকে কেবল নিজেদের প্রয়োজনমাফিক ছাঁচ ও ব্যবহারযোগ্য ভেবেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে পশ্চিমাদের অসীম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা। এর ফলে দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতার (global warming) মতো ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।

পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের উপনিবেশগুলোতে নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার ফলে ক্ষতি হয় আরো গভীরে। মূলত ঔপনিবেশিক প্রশাসনব্যবস্থার কেরানি তৈরির জন্য এবং পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতিতে প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করাই ছিল এই পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের উপনিবেশগুলো ছেড়ে যাওয়ার সময় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত এই অভিজাত শ্রেণীর কাছেই ক্ষমতা অর্পণ করা যায়। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী মোটা দাগে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রচলিত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও অভিজাত সাংস্কৃতিক কাঠামোই বজায় রাখে, যা মূলত নিও-কলোনিয়ালিজম নামে একটি নতুন ফেনোমেনোনের জন্ম দেয়।

ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত
বাংলাদেশে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন শুরু হয় কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে, পরবর্তীতে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন ধর্মহীনতা ও ইসলামবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। সাম্প্রতিককালে সেক্যুলার শিক্ষা বিস্তারে প্রয়াস অব্যাহত আছে। বর্তমান সরকার প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মশিক্ষা বাদ দিয়ে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে ধর্মহীন শিক্ষা মানুষকে ধীরে ধীরে নৈতিকতা বিবর্জিত অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়।

জীবনপদ্ধতি ও দর্শনবর্জিত শিক্ষা : বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারা আল্লাহ বিমুখ ও ঈমান, আকিদা বিবর্জিত দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আদর্শিক জীবন ও দর্শন লাভ করার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ অহি ও নবুয়্যতের মাধ্যমে মানুষের জন্য যে হিদায়াত ও জীবনযাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষাব্যবস্থা সে সম্পর্কে শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এভাবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলামী জীবন ও দর্শনবিমুখ একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে সরকার ও ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো।

প্রকৃত লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা : ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মাঝে এক আল্লাহর আনুগত্য করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তিলাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহপ্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদের পেশ করার যোগ্যতা অর্জন এবং খিলাফত পরিচালনা এবং মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ভাবধারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা জীবনের কোনো মহৎ লক্ষ্য অর্জনের শিক্ষা লাভ করে না এবং শ্রেষ্ঠ গুণাবলী ও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে না।

নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত জাতি তৈরি : একটি জাতি যখন নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত হবে তখন সেই জাতি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে। ইসলামবিরোধী ও সেক্যুলার গোষ্ঠী এটাই চায়। সেজন্য তারা এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে যা বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে ফেলেছে। এরূপ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/818760