৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:২৭

খেজুর নিয়ে খেলছে কারা

রমজান সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ খেজুর আসার পরও নাগালের বাইরে এর দাম। আমদানি মূল্যের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। রমজান ঘিরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত পাঁচ মাসে ৩৫০ কোটি টাকায় প্রায় ৩২ হাজার টন শুকনা ও ভেজা খেজুর আনেন ৮০ জন। তবে এর মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ আমদানি করেছেন মাত্র দুই ডজন ব্যবসায়ী। তারাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন বাজার।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গতবারের তুলনায় ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, কাস্টমসে শুল্কহার ৮ থেকে ১০ গুণ ও আগের তুলনায় এবার আমদানি কম হওয়ার কারণে দাম বেশি। কিন্তু ভোক্তারা মনে করছেন, কিছু ব্যবসায়ীর ‘অতি মুনাফা প্রবণতা’র কারণেই খেজুরের দাম এতটা অস্থির। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, প্রশাসনের মনিটরিংয়ে দুর্বলতা আছে। দাম বাড়ানোর কারসাজির সঙ্গে যুক্ত কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারছে না তারা। এ জন্য খেজুর নিয়ে বাজারে এতটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
উচ্চ, মধ্য ও সাধারণ মানের দশ ধরনের খেজুরের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারে প্রতি কেজি খেজুরের গড় দাম পড়ছে প্রায় ৮০০ টাকা। কিন্তু কাস্টমসে প্রদর্শিত আমদানিমূল্য, শুল্ক এবং পরিবহন খরচ যোগ করলে প্রতি কেজি খেজুরের গড় মূল্য দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। বাজারে এর দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।

খেজুর নিয়ে সবচেয়ে বেশি কারসাজি হচ্ছে খুচরা বাজারে। দেশে প্রতিবছর ফলটির চাহিদা প্রায় ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে অর্ধেক চাহিদা থাকে শুধু রমজানে। গত বছরের তুলনায় এবার কিছুটা কম আমদানি হলেও চাহিদার কাছাকাছি এসেছে।

যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ
খেজুরের বেশির ভাগ আমদানি করে এখন বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে ২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট । সর্বোচ্চ ৩ হাজার টন থেকে সর্বনিম্ন ১০০ টন আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে– অ্যারাবিয়ান ডেটস ফ্যাক্টরি, মদিনা ফ্রুটস লিমিটেড, রয়েল ফ্রেশ ফুডস, মেসার্স আরাফ এন্টারপ্রাইজ, আল্লাহর রহমত স্টোর, সাপোয়ানা ফুড ট্রেডিং করপোরেশন, রামিসা বিডি লিমিটেড, এডি ফ্রুটস লিমিটেড, হৃদয় এন্টারপ্রাইজ, সাউদার্ন ট্রেডিং, জেবি অ্যান্ড ব্রাদার্স, জেসপার ট্রেডিং, ওয়াসিফ ট্রেডিং, আল আনসার ফুডস, আস সাফা ওয়াল মারওয়া ট্রেডিং, ফারিয়া ট্রেডিং, মনসুর কোল্ডস্টোর, প্যারাগন এন্টারপ্রাইজ, হারুন স্টোর, শাকিল ফ্রেশ ফ্রুটস কোম্পানি, ট্রেড লিঙ্ক এজেন্সি, রিজভী ফ্রুটস, সবুজ এন্টারপ্রাইজ, সুপ্তি ট্রেডার্স ও লায়াম ফ্রেশ ফ্রুটস।

গত তিন বছরের আমদানিচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রমজান ঘিরে সবচেয়ে বেশি শুকনা ও ভেজা খেজুর আমদানি করছে ঘুরেফিরে একই প্রতিষ্ঠান। কার্টন ও বস্তায় করে খেজুর এসেছে দেশে। প্যাকেটে ভেজা খেজুর এনেছেন ২০ থেকে ২৫ জন ব্যবসায়ী। ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার খেজুর এনেছেন তারা। আর ভেজা খেজুর এনেছেন ৫৫ থেকে ৬০ জন ব্যবসায়ী। সব মিলিয়ে তারা গত পাঁচ মাসে ২৭০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার খেজুর এনেছেন। রমজান সামনে রেখে এবার সাড়ে ৩০০ কোটি টাকায় প্রায় ৩২ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে। এগুলো খালাসের আগে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে শতকোটি টাকার বেশি।

বাজারের চিত্র
সৌদি আরবের ‘আজওয়া’ খেজুর ৫ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ টাকায়। গত বছর দাম ছিল ২ হাজার ৬০০ টাকা। মেজদুল (আম্বর) খেজুরের ৫ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৮০০ টাকায়। গতবার দাম ছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকা। একইভাবে মেজদুল (সাধারণ) মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার টাকায়। গতবার দর ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা। মরিয়ম খেজুরের ৫ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার টাকায়। গতবার ছিল আড়াই হাজার টাকা। এ ছাড়া ইরানের কামরাঙ্গা মরিয়ম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা, সাধারণ মরিয়ম ৮০০ টাকা, তিউনিসিয়ার প্যাকেটজাত খেজুর ৭০০ টাকা, দাবাস ২২০ টাকা, ফরিদা ৩০০ টাকা, বরই ৩০০ টাকা, নাগাল ৪০০ টাকা এবং বাংলা খেজুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ভালো জাতের মরিয়ম বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। তবে খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত মাসে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়েছে সরকার।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য
জানতে চাইলে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, খেজুরের দাম কেন লাগামছাড়া, তা খতিয়ে দেখা উচিত। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে দেশের ১৬ কোটি মানুষ কষ্ট পাক এটা আমরাও চাই না। খাতুনগঞ্জের অন্যতম খেজুর আমদানিকারক অমল ভূষণ নাগ বলেন, খেজুর পচনশীল পণ্য। যা আনা হয়, তার অর্ধেক অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। তাই উন্নতমানের প্যাকেট খেজুরের দাম একটু বেশি।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ডলার রেট ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেশি। কাস্টমসে শুল্ক বেড়েছে ৮ থেকে ১০ গুণ। আমদানিও এবার অনেক কম। এজন্য বাজার কিছুটা অস্থির। খুচরা বাজারে কেউ কেউ দ্বিগুণ দামে খেজুর বিক্রি করলেও পাইকারিতে এটা করার সুযোগ নেই।

তবে ক্যাবের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, পর্যাপ্ত খেজুর আমদানি হয়েছে এবারও। সরকার ১০ শতাংশ শুল্কও ছাড় দিয়েছে। তবে মনিটরিংয়ে দুর্বলতা রয়ে গেছে। আবার দাম নিয়ে যারা কারসাজি করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পারছে না প্রশাসন। তাই বন্দরে খেজুর আসার পরও তা খালাস করেনি অনেকে। খেজুরের বাজার ক্রমেই অস্থির হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে এসব কারণ।

https://samakal.com/bangladesh/article/225866