৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:০৯

জিকে প্রকল্প বন্ধ : চার জেলার কয়েক লাখ চাষি দিশেহারা

সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষের ৩ পাইপ নষ্ট

দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষের (জিকে) কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কুষ্টিয়াসহ পার্শ্ববর্তী চার জেলার কয়েক লাখ চাষি। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন চার গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে কোনো মতে ধানের জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। কবে থেকে আবার সেচ প্রকল্পের পানি ধানের জমিতে গড়াবে তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। তিনটি পাম্পের মধ্যে দু’টি অচল হয়ে রয়েছে প্রায় দুই বছর ধরে। বাকি পাম্পটি দিয়ে কোনো মতে সেচকার্যক্রম চলছিল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘সবে ধন নীলমণি’ পাম্পটিও অকেজো হয়ে পড়েছে।

১৯৫১ সালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর তীরে স্থাপন করা হয় দেশের বৃহৎ গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচপ্রকল্প। ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলাগুলোর প্রায় চার লাখ হেক্টর জমি এ প্রকল্পের আওতায় এনে এই সেচ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পদ্মা নদীর উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমে আসার পর থেকে এই সেচ প্রকল্পের আওতাধীন আবাদি জমির পরিমাণ থাকে। বর্তমানে এ প্রকল্পের আওতায় কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গার প্রায় সোয়া লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। ইনটেক চ্যানেলের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে পানি নিয়ে তিনটি পাম্পের মাধ্যমে প্রকল্পের প্রধান খালে ফেলা হয়। শাখা-উপশাখা খালের মাধ্যমে সে পানি চলে যায় কৃষকের খেতে। ২০২২ সালে প্রকল্পের দু’টি পাম্প অকেজো হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়াসহ নানা জটিলতায় ওই পাম্প দুটো আর চালু হয়নি। বাকি পাম্পটি দিয়ে কোনো মতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল এ প্রকল্পের কার্যক্রম। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ওই পাম্পের সাহায্যে খালে সেচের পানি সরবরাহ শুরু হয়। তবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অচল হয়ে যায় শেষ সম্বল ওই পাম্পটিও। ফলে গত দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ সেচের পানি সরবরাহের কাজ। এতে চরম বিপাকে পড়েছে চার জেলার কয়েক লাখ কৃষক তথা বোরো চাষি। জিকে প্রকল্পের পানিতে নামমাত্র মূল্যে কৃষকরা ধানের আবাদ করে থাকে। তবে এবার বোরো মৌসুমের শুরুতেই প্রকল্পের পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের কপালে। এরই মধ্যে অনেক জমিতে বোরোর চারা রোপণ করা হলেও এখনো বেশ কিছু জমিতে রোপণ বাকি রয়েছে। কৃষকরা বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এতে তাদের অনেক বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। আবার অনেকে পানির অভাবে এখনো চারা রোপণ করতে পারেননি বীজতলায় নষ্ট হচ্ছে ধানের চারা। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কলাবাড়ি এলাকার কৃষক সরোব আলী জানান, বোরো, আমন, আউশ- এই তিনটি মৌসুমে তিনি জিকে প্রকল্পের আওতায় জমিতে ধান চাষ করেন। জিকের পানিতে নামমাত্র সেচ খরচের মাধ্যমে তিনি এতদিন ধান আবাদ করে এলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রকল্পের পানি না পাওয়ায় এবার শ্যালো মেশিনের সাহায্যে জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কৃষক হাসেম আলী বলেন, এবার বোরো ধান চাষ করা তাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়বে। চড়া মূল্যে ডিজেল কিনে ধানের জমিতে সেচ দেয়া খুব ব্যয় বহুল হবে। তিনি বলেন, তার মতো ওই এলাকায় হাজার হাজার বোরো চাষি এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি অবিলম্বে জিকে প্রকল্পের পাম্প সচল করে সেচ কার্যক্রম চালুর দাবি জানান। এ দিকে পাম্পগুলো কবে নাগাদ সচল করা সম্ভব হবে তাও বলতে পারছে না জিকে কর্তৃপক্ষ। জিকে পাম্প হাউজের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে প্রকল্পের একমাত্র চালু পাম্পটিও অচল হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তারাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তারা দেশী অথবা বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পাম্পগুলো ঠিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কবে নাগাদ পাম্পগুলো ফের চালু করা যাবে তা বলতে পারেননি মিজানুর রহমান। নাম প্রকাশ না করা শর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে পাম্প নষ্টের পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ফরিদপুরে মিটিং হয়েছে। জিকে সেচখালে পানি ব্যবস্থাপনায় দ্রুত বর্তমান সমস্যা নিরসনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সূত্রটি আরো জানায়, পাম্প মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থছাড়ের ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চলছে। তবে মেরামত না করে নতুনভাবে পাম্প সংযোজনের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কেননা মেরামত করলে পুনরায় একই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তার চেয়ে নতুন পাম্প সংযোজনের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান হলো উত্তম ব্যবস্থা। এ দিকে জিকের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুল হামিদের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি না ধরায় সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পার্থ শীল জানান, জিকে সেচ বন্ধ থাকার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাপানি টেকনিশিয়ান আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি সেচ এলাকায় বোরিং চালানো নিষিদ্ধ থাকায় বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে কথা হয়েছে জিকে সেচ সম্প্রসারণ এলাকার চাষিদের সেচকাজের সুবিধার্থে প্রয়োজনবোধে চাষিদের বোরিংয়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরো জানান, জেলা প্রশাসক বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সচিবের সাথে কথা বলেছেন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সবার সাথেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/818626