৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৭:০৬

৮ম বারের মতো বাড়লো এলপি গ্যাসের দাম

টানা ৮ম বারের মতো এলপিজি সিলিন্ডারের দাম আরও বাড়লো। ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৭৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৮২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে অটোগ্যাসের দামও। অটোগ্যাসের দাম লিটারপ্রতি ৬৭ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬৮ টাকা ০৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গতকাল রোববার নতুন এই দর ঘোষণা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), যা রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে কার্যকর হবে। ১২ কেজি সিলিন্ডার ছাড়াও সাড়ে পাঁচ কেজি থেকে শুরু করে ৪৫ কেজি পর্যন্ত সব সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয়েছে।

সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, মার্চ মাসে সৌদি এরামকো প্রোপেন ৬৩৬.৫০ এবং বিউটেন ৬৩৬.৫০ মার্কিন ডলার হিসাব করে কমিশন এলপিজির দর নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশে প্রোপেন বিউটেনকে ৩৫:৬৫ অনুপাতে মিশ্রিত করে এলপিজি তৈরি করা হয়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়ানো হয় এলপিজির দাম। ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৪১ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৭৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একইসঙ্গে অটোগ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৬৭ টাকা ৭৬ পয়সা করা হয়।

তারও আগে জানুয়ারি মাসে ১২ কেজির দাম ১ হাজার ৪০৪ টাকা থেকে ২৯ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৩৩ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি।
বিইআরসির আদেশে আরও বলা হয়, রেটিকুলেটেড পদ্ধতিতে তরল অবস্থায় সরবরাহ করা বেসরকারি এলপিজির দাম ১১৯ টাকা ০৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৬৬ টাকায় সমন্বয় করা হয়েছে।

বাজারে এলপি গ্যাসের অতিরিক্ত দাম রাখার অভিযোগ পুরোনো। সংশ্লিষ্ট কমিশনে অভিযোগ করেও মিলছে না সুফল। রান্না কাজে ব্যবহূত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দামে বছরজুড়ে ঠকছেন ভোক্তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতিমাসের শুরুতে বিশ্ব বাজারের সাথে সমন্বয় করে নতুন দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বিইআরসি। এরই মধ্যে বেড়েই চলছে এলপিজির দাম। ২০২৩ সালে টানা ৬ বার এবং চলতি বছরে প্রথম ২ মাসে ২বার বেড়েছে রান্না কাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই এলপিজি দাম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলপি গ্যাসের কাঁচামাল হিসেবে পরিচিত প্রোপেন ও বিউটেন। এসব কাঁচামালের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েই চলছে এলপিজির দাম। তারা বলছেন, যৌক্তিক কারণ ছাড়া দাম বৃদ্ধি করা অনুচিত। গত ৩ ডিসেম্বর সৌদি আরামকো কর্তৃক প্রোপেন এবং বিউটেনের ঘোষিত সৌদি সিপি (কন্ট্রাক্ট প্রাইজ) প্রতি মেট্রিক টন যথাক্রমে ৬১০.০০ মার্কিন ডলার এবং ৬২০.০০ মার্কিন ডলার ধরে দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি।

বিইআরসি কর্তৃপক্ষ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী প্রতিমাসে আমরা দাম নির্ধারণ করি। সেখানে বাড়লে দেশেও বাড়ে, তারা কমালেও আমরাও কমাতে পারি। প্রতিমাসে দাম নির্ধারণ করলেও এর সুফল গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে নীতি নির্ধারণী সংস্থা বিইআরসি।

ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছে এমন অভিযোগ খুচরা গ্রাহকদের। আবার অনেকে ‘কখন দাম বাড়ে- কমে’ সে খবর জানেন না।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা শিরিন চৌধুরী জানান, আমি সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি সিলিন্ডার পাচ্ছি না। দোকানদার যে দাম চায় সে দামেই আমাদের দিতে হয়। মহল্লার দোকানগুলোতে দরকষাকষিরও সুযোগ থাকে না। তিনি এক সিলিন্ডারে ৩৫০ টাকা ঠকেছেন। গত অক্টোবরে ২২ কেজি সিলিন্ডার কেনেন দুই হাজার ৮৫০ টাকায়। অথচ তখন বিইআরসি ঘোষিত দাম ছিল দুই হাজার ৫০০ টাকা। ভোক্তাদের অভিযোগ তারা রীতিমতো ঠকছেন। নিত্যপণ্যে চওড়া দামে এমনিতেই দিশেহারা গ্রাহক। তার মধ্যে এমন ঠকবাজি চলছে বাজারে। রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় খবর নিয়ে জানা যায়, বিইআরসির বেঁধে দেয়া দামে কোথাও মিলছে না এলপি গ্যাস। বছরজুড়ে এমন নৈরাজ্যে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। গ্রাহকরা অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার যদি দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে প্রতিমাসে এলপিজির দাম ঘোষণা করার মানে হয় না।

নিত্যপণ্যে বাজারে যেতেই এখন বুক কাঁপে বলে জানান রামপুরা এলাকার বাসিন্দা শামসুল হক। তিনি বলেন, এর মধ্যে সরকার নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার পেলেও কিছুটা বাঁচা যেত। প্রতি বোতলে ৩০০-৪০০ টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে।

একদিকে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি। এরপর আবার বহুল ব্যবহৃত এলপিজি কিনতে গিয়ে ভোগান্তি আর বিড়ম্বনায় পড়ছেন অনেককে। গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা রহমত আলী নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস কিনতে পারেননি বলে জানান এ প্রতিবেদককে। বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়েই কিনতে হয়েছে তাকে।

এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা বিইআরসি নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস কিনতে পারি না। রাজধানীর বনশ্রীর এক খুচরা এলপিজি ব্যবসায়ী জানান, ডিলারদের কাছ থেকে আমরা বিইআরসি ঘোষিত দামে সিলিন্ডার কিনতে পারি না। সুতরাং আমাদেরও একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এর সঙ্গে প্রত্যেক বোতলের পরিবহন খরচ রয়েছে। এরপর তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, দোকান ভাড়া, কর্মচারী, আমার নিজের সংসার আছে আমার তাহলে কত বিক্রি করা উচিত?

দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। কোম্পানিগুলো বলছে, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তাদের কাছে দাম বেশি নিচ্ছে। অন্যদিকে ডিলার ও আমদানিকারকরা বলছেন, আমরা সরকার নির্ধারিত দামে কিনতেই পারছি না। ২০২৩ সালে জানুয়ারি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৬৫ টাকা কমিয়ে এক হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। যার আগের দাম ছিল এক হাজার ২৯৭ টাকা। পরবর্তী সময়ে ফেব্রুয়ারি মাসে এক লাফে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মার্চ মাসে ৭৬ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৪২২ টাকা। এপ্রিল মাসে আবারও ২৪৪ টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ১৭৮ টাকা। পরবর্তী সময়ে মে মাসে ৫৭ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর জুন মাসে আবারও দাম কমে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৫৯ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৭৪ টাকা। জুলাই মাসে হাজার টাকার নিচে নামে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম। ৭৫ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৯৯৯ টাকা। পরে টানা পাঁচ মাস ধরে বাড়তে থাকে এলপিজির দাম। আগস্ট মাসে ১৪১ টাকা বাড়িয়ে ১১৪০, সেপ্টেম্বরে ১৪৪ বাড়িয়ে ১২৮৪, অক্টোবরে ৭৯ টাকা বাড়িয়ে ১৩৬৩, নভেম্বরে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৮১ ও ডিসেম্বর মাসে ২৩ টাকা বাড়িয়ে ১৪০৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। সর্বশেষ চলতি বছরের শুরুতে এবং গতকাল রোববার আবারো বাড়ে এলপি গ্যাসের দাম।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, আমাদের দেশে ভোক্তারা পদে পদে ঠকছে। বিইআরসি এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করতে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষুন্ন হচ্ছে ভোক্তা অধিকার। দেশের ব্যবসায়ীরাও আইন মানছেন না, তার প্রমাণ এলপিজি খাত। বাজার প্রতিযোগিতামূলক করতে নির্ধারিত দামে বিক্রি করায় আগ্রহী কোম্পানিকে নতুন করে লাইসেন্স দিতে পারে বিইআরসি।

বিইআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ববাজারের সাথে সমন্বয় করে আমরা দাম নির্ধারণ করে থাকি। খুচরা বাজারে বেশি দামের বিষয়ে তারা বলেন, আমরা বাজার মনিটরিং করছি। লোকবল কম থাকায় আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে পেরে উঠছি না। গ্রাহক পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা বেশি দামে এলপিজি বিক্রির অভিযোগে ইতোমধ্যে কয়েকটি কোম্পানিকে শোকজ করেছি। নূরুল আমিন আরও বলেন, যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ডলার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে অতি জরুরি এই পণ্যটির দাম নির্ধারণ করে আসছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিইআরসি। এর আগে এই দাম কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন ছিল। এরপর থেকে দাম ঘোষণার সময় বলা হয়, আমদানি-নির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তিমূল্য ধরা হবে। প্রতি মাসেই সমন্বয় করা হবে। সৌদির দর ওঠা-নামা করলে ভিত্তিমূল্য ওঠানামা করবে। অন্যান্য কমিশন অপরিবর্তিত থাকবে। তখন থেকেই প্রতি মাসে দাম নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি।

https://www.dailysangram.info/post/550377